বঙ্গবন্ধু সোনার মানুষ
হীরেন পন্ডিত
প্রকাশিত : ০৭:৫৮ পিএম, ২২ জুন ২০২৪ শনিবার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুকাল থেকেই ছিলেন জনদরদী। শিশু মুজিব দরিদ্র ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষা প্রদানের জন্য নিজ পরিবারসহ পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করতেন। তিনি অনেক ছাত্রের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তিনি নিজ আদর্শ এবং দেশের মানুষের কল্যাণের ব্রত থেকে সরে যাননি কখনও। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানিদের শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি মানুষের জন্য লড়াই করেছেন, অধিকাংশ সময় অসহায় জীবনযাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা, শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহপাঠী ও ছাত্রদের কল্যাণে ছাত্রাবস্থায় নিজেকে সঁপে দেয়ার ঘটনা, দেশ ও জাতি গঠনে নিজেকে তৈরি করেছিলেন হিতাকাক্সক্ষী শিক্ষানুরাগী, পরোপকারী মানুষের রোল মডেল। তিনি মনে করতেন সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আগে সোনার মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ একটি দেশের প্রধান সম্পদই হচ্ছে মানবসম্পদ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই ছিল দেশের মানুষকে সম্পদে পরিণত করা।
বঙ্গবন্ধু আমাদের ছাত্রসমাজকে নিয়ে ভাবতেন তিনি বলতেন, ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারাই হয়ে ওঠবে এক আদর্শবান শক্তি। এই আদর্শ মানুষ বলতে তিনি এমন ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন, যে উন্নত মানবিক গুণাবলি ধারণ করবে ও অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য হবে। অর্থাৎ সামাজিকভাবে যা কিছু ভালো-শ্রেষ্ঠ মহৎ ও কল্যাণকর সব কিছুই থাকবে ছাত্রসমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে। আদর্শ মানুষ হতে হলে সবার ভেতর যেসব গুণ থাকা দরকার সেগুলো হলো- সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রমী ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন একজন আদর্শবাদী মানুষ। বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ।
১৯৭৩-এর ১৯ আগস্ট ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবারা একটু লেখাপড়া শেখ। যতই জিন্দাবাদ আর মুর্দাবাদ করো, ঠিকমতো লেখাপড়া না শিখলে কোনো লাভ নেই। আর লেখাপড়া শিখে যে সময়টুকু পাবে বাবা-মাকে সাহায্য করেবে। প্যান্ট পরা শিখছ বলে বাবার সাথে হাল ধরতে লজ্জা করো না। দুনিয়ার দিকে চেয়ে দেখ। গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুনগাছ লাগাও, কয়টা মরিচগাছ লাগাও, কয়টা লাউগাছ লাগাও ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগাও। বাপ-মাকে একটু সাহায্য করো। শুধু বিএ-এমএ পাস করে লাভ নেই। দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে’।
১৯৭৩-এ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় তিনি বলেছেন ‘বাংলার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না’।
চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগ স্বীকার করে এগোতে পারলে সঠিক মানুষ হিসেবে, নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়, অর্থ-সম্পদের পেছনে ছুটলে, ওই অর্থ সম্পদে ভেসে যেতে হয়; নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা থাকে না, দেশকেও কিছু দেয়া যায় না, মানুষকেও দেয়া যায় না।’
পাশাপাশি ছাত্রদের যেটা সব থেকে বেশি দরকার, লেখাপড়া শিখতে হবে। উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে প্রজন্ম বা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে। সবার মাঝে থাকবে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও পরোপকারী মনোভাব, মানবদরদি-সহমর্মিতা, নির্লোভ-নিরহংকার এবং সাহস।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে মানুষ। তাই মানুষকেই সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন এ দেশের মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষই সম্পদ। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি অর্থবহ, সীমাহীন পরিধিযুক্ত এবং ইঙ্গিতবাহী। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব নিলেন, তখন তার সামনে দেশ গঠনই ছিল মূল লক্ষ্য। নতুন এ দেশকে বিশ্বের দরবারে স্থান করে দেওয়া, দেশের সব নীতি ও বিধান তৈরি করা, বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর সঠিক রূপদান, সর্বোপরি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া ছিল তার অগ্রাধিকার কাজ।
দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ তখনো ভেতরে দৃপ্ত, তীক্ষ্ণ টগবগে মন; তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান; তাদের নিজ নিজ কাজে ফিরিয়ে নেওয়া এবং কর্মে মনোনিবেশে উদ্বুদ্ধকরণ। এই কাজগুলো করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হন। তিনি লক্ষ্য করেন চারদিকে ভালো মানুষের অভাব। অনৈতিক ও অসদাচরণ কাজে মানুষের বড় বেশি সম্পৃক্ততা দেখে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তিনি আহ্বান জানান সবাইকে ভালো হতে, দেশকে ভালোবাসতে, ধৈর্যধারণ করতে, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াগুলো কমিয়ে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য কাজ করার জন্য। একই সঙ্গে তিনি খুঁজতে লাগলেন সোনার মানুষ। সোনার দেশ গড়তে হলে সোনার মানুষ প্রয়োজন- এটি তিনি বিভিন্ন জনসভায়, আলোচনায়, কথাবার্তায় বারবার উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার মানুষের আহ্বান এখনো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। আজ বেশি করে আমরা উপলব্ধি করি সোনার মানুষের প্রয়োজনীয়তা।
বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ আসলে কারা, এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করার মতো। শৈশব ও কৈশোর, মানুষ যখন শিক্ষার্থী-ছাত্রকে নিয়ে যদি কল্পনা করি, তা হলে কেমন হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো চরিত্র গঠন। লেখাপড়া, খেলাধুলা, বুদ্ধিমত্তার চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ এবং সদগুণ, আচার-ব্যবহার, নৈতিক স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম জাগ্রত হওয়া, সত্যের চর্চা করা, মানুষকে ভালোবাসা, অন্যের প্রতি উপকারী হওয়া- এসব নিয়েই গড়ে উঠবে সামগ্রিক চরিত্র। শিশু, কিশোর, ছাত্র, যুবকদের মধ্যে এ বিষয়গুলো যদি বজায় থাকে তাহলে তাকে আমরা বলতে পারি সোনার মানুষ।
তিনিই সোনার মানুষ- যিনি সৎ, বিনয়ী, পরোপকারী, নীতিবান আর দেশপ্রেমের আপোসহীন। তিনি যদি হয়ে ওঠেন কর্তব্যপরায়ণ, দায়িত্বশীল, দেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালনকারী, স্বাবলম্বী, যোগ্য, মেধাবী, পরিশ্রমী হন তা হলে তিনি সোনার মানুষ। এ জন্য শিক্ষা ও যোগ্যতায় এগিয়ে থাকতে হবে। সোনার মানুষ তিনি যিনি কর্মোপযোগী ও আচরণে সঠিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত, স্বাধীন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এ জন্যই দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের সঙ্গে সোনার মানুষ সম্পর্কিত। বঙ্গবন্ধু কঠোর সংগ্রামী একজন মানুষ। তার স্বপ্ন ভবিষ্যতের বাস্তবতা। দেশ নিয়েই তার সব ভাবনা, চিন্তা ও পরিকল্পনা। তার এসব স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যই তিনি চেয়েছিলেন সোনার মানুষ। আর তিনি জানতেন সোনার মানুষ সোনার হরিণ নয়।
তাই তিনি তার ভাষণে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন- ‘একটা কথা আমি প্রায় বলে থাকি, আজও বলছি। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’
এ কথা বঙ্গবন্ধুর কোনো বিচ্ছিন্ন উক্তি নয়, একটিমাত্র ভাষণের উক্তিও নয়; তিনি অনেকবার এই কথা উচ্চারণ করেন। এটি তাঁর উপলব্ধি। ছাত্রদের চরিত্র গঠন ও সুনাগরিক হয়ে ওঠার কথা তিনি বারবার বলতেন। সুনাগরিকের গুণাবলি হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য, পরিশ্রমী, দুর্নীতিমুক্ত ইত্যাদি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সেই তরুণ বয়স থেকেই। নির্লোভ-নির্মোহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেন, ‘আদর্শহীন অনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কোনো দল সংগঠিত হলে সেটি দেশের বা দেশের জনগণের মঙ্গলের পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যক্তি কল্যাণ বা স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সেটিই বারবার প্রতীয়মান হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র-সমাজ দর্শনের যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো ধর্মবর্ণ-দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সামগ্রিক আপামর জনগণের কার্যকর মঙ্গল সাধন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের ধর্মকে ভালবাসে, কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।’
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাষ্ট্র-সমাজ চিন্তা-চেতনা বরাবরই জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই স্থির, যার মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থার টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিতে দুর্নীতিকেই বঙ্গবন্ধু প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং তা নিধনকল্পে প্রায় প্রতিটি বক্তব্য-ভাষণে জনগণকে এই ব্যাপারে সচেতন করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত শাসন পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার ছিল নিখাদ এবং দুর্নীতি নিধনকল্পে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক, যুগোপযোগী এবং খোলামেলা। অকপটেই তিনি এসব বিষয়কে জনগণের সম্মুখে প্রকাশ এবং এর প্রতিকারে সহযোগিতার আহ্বান করেছেন।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও ব্যর্থ হয়ে যায়। কেবল আওয়ামী লীগের সরকার হলে চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে জনগণেরও সরকার। সাড়ে সাত কোটি মানুষ, মানুষের সরকার। এটা সম্বন্ধে পরিষ্কার থাকা দরকার। আপনাদের কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। বিরোধীদলে থাকা এক রকমের পন্থা, আর সরকারের পক্ষে রাজনীতি করা অন্যরকম পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজের দিকে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে, অত্যাচার যেন না হয়, জুলুম যেন না হয়, লুটপাট যেন না হয়।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘দেশের মানুষকে সেবা করে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম, দিনের বিশ্রাম হারাম, আমাদের কাজ করতে হবে। দুঃখী মুখে হাসি ফোটাতে হবে। ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করেছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। লোভের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। লোভ যেখানে ধ্বংস সেখানে। একবার যদি কেউ লোভী হয়ে যায়, সে জীবনে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। শুধু আপনার মুখে কালি দেবেন না, কালি দেবেন সেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে। যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ সব স্বাধীন হয়েছে।’
১৯৭২ সালে মহান মে দিবসে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি-গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের ভোগ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্ত এই সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না।’
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা জানেন, জীবনে আমি কোনদিন মিথ্যা ওয়াদা করিনি। আমি জীবনে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি। একদিকে ছিল আমার প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন আর একদিকে ছিল আমার ফাঁসির ঘর। আমি বাংলার জনগণকে মাথা নত করতে দিতে পারি না বলেই ফাঁসিকাষ্ঠ বেছে নিয়েছিলাম। সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার দুঃখী মানুষ বাঁচতে পারে না। সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি।’
ঘুষ-সুদখোর, মজুতদার, চোরাকারবারি, চোরাচালানি, অন্যের জমি-বাড়ি দখলদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কঠোর ভাষায় শুধু সাবধান করেননি, তাদের আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বহুবার।
১৯৭২ সাল, ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছো, যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছো, যারা মজুদ করছ, জিনিসপত্র বিক্রি করছ না, জিনিসের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছ, তাদের রেহাই নেই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব-দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নেই।’
সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ সাবলীল ভঙ্গিতে সোনার মানুষ সন্ধানে অবিচল এবং প্রায়শ এই দেশের নির্লোভ, নির্মোহ ও ত্যাগী ব্যক্তিদের উজ্জীবিত করার নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন।
১৯৭২, ৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এক জনসভায় বলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ পয়দা করতে হবে। এই চাটার অভ্যাস ত্যাগ করো। চাটার গোষ্ঠীর জ্বালায় আমি তিতে হয়ে গেলাম। এই চাটার গোষ্ঠীকে আমি বার বার ওয়ার্নিং দিচ্ছি। চাটার গোষ্ঠী আমার দলেই হোক, অন্য দলেই হোক, অন্য জায়গারই হও, তোমাদের আমি ক্ষমা করতে পারব না। আল্লাহও ক্ষমা করবে না।’
দুর্নীতি দমন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে নিরপরাধ, নিরীহ, সৎ ব্যক্তিদের হয়রানি ও মিডিয়ার মাধ্যমে ফাঁসিয়ে দেওয়ার কুৎসিত প্রচেষ্টা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি বলেন, ‘কোনো সাপ্তাহিক বা সান্ধ্য দৈনিকে কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখে তাকে বলা হতো- টাকা দাও, নইলে আবার তোমার বিরুদ্ধে লেখা হবে। তখন সত্যি সত্যিই টাকা দিয়ে সে কাগজের মুখ বন্ধ করা হতো। আমি লক্ষ্য করছি এখানেও এই ধরনের একটা প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আরও দেখা যাচ্ছে, যার আয়ের কোনো প্রকাশ্য উৎস নেই, সেও দৈনিক কাগজ বের করছে। রাতারাতি কাগজটা বের হয় কোথা থেকে? পয়সা দেয় কে?’
১৮ আগস্ট, ১৯৭৪ সাল, বন্যাকবলিত জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, একটা কথা আজ আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জনগণের দুর্দশাকে মূলধন করে যারা মুনাফা লুটে সেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবার, মজুদদার ব্যবসায়ীদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। রিলিফ বণ্টন নিয়ে কোনো ছিনিমিনি খেলা বরদাশত করা হবে না। ক্ষুধার্ত মানুষের গ্রাস যারা কেড়ে নেয় তারা মানুষ নয়, মানুষরূপী পশু। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আমি এই পশুদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে চাই। কিন্তু জনগণের সাহায্য ছাড়া এ সম্ভবপর নয়। তাই জনগণের সাহায্য আমি কামনা করি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি আর আপনি মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন? গরিবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনারা নয়, সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদেও সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটাও নিরপরাধ লোকের উপর যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের জন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠছে একটা নতুন প্রজন্ম। মুজিবময় এই বাংলায় একদিন প্রতিটি মানুষই হয়তো হয়ে উঠবে সোনার মানুষ। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ, দর্শন জানা এবং চর্চা করা। নতুন প্রজন্মের নবীন-তরুণদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যত আগ্রহ সৃষ্টি করা যাবে, তারা ততই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।
লেকক: হীরেন পন্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট
এমএম//