ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

প্লাটিনাম জয়ন্তী: কালের দর্পণে আওয়ামী লীগ 

ড. রাশিদ আসকারী

প্রকাশিত : ০৬:১২ পিএম, ২৪ জুন ২০২৪ সোমবার

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে লাল সূর্য ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয়েছিল, তা প্রায় দু’শ বছর পর আরেক ২৩ জুন  (১৯৪৯) সালে পুনরায় উদিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় পুরনো ঢাকার কে.এম. দাস লেনের 'রোজ গার্ডেন' নামক একটি ঐতিহাসিক স্থানে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে  বাংলার মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল  হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার গ্রামীণ জনপদের নেতা শামসুল হককে সেক্রেটারি, ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ এবং ২৯ বছর বয়সী উদীয়মান যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে একটি গণমানুষের রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। সেই রাজনৈতিক ওডিসি আজ পঁচাত্তর বছর অতিক্রম করলো। 

আওয়ামী লীগের ইতিহাস উপমহাদেশের এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক বিবর্তনের  ইতিহাস। এক বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতায় সংগ্রামী উত্তরণের ইতিহাস। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতাবাদের সুদীর্ঘ চর্চা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রশ্রয়পুষ্ট হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের এক উদ্ভট খড়গ দিয়ে দেশভাগ করে পাকিস্তানে যে নয়া উপনিবেশবাদের জন্ম দেয়, যুগ ও জাতির অনিবার্য প্রয়োজনে তাকে নস্যাৎ করার নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার নিয়ে জন্মলাভ করে আওয়ামী লীগ। পাক ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে  এক স্বতঃস্ফূর্ত  গণআন্দোলনের সূতিকাগার এই গণমানুষের দল। নিখিল পাকিস্তানের একটি অংশের স্বাধিকারের এক সচেতন জনপ্রিয় দাবি নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আওয়ামী লীগের,  যা পাকিস্তান সরকার কর্ণপাত করেনি। 

বস্তুত দেশভাগের অব্যবহিত পরেই পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ মুসলিম লীগ সরকারের চরম বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের প্রতি মোহমুক্ত  হয়ে পড়ে। উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি  মোকাবেলা করা এবং বিদ্যমান  রাজনৈতিক  প্রত্যাশা পূরণের জন্যে একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল। আবার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম লীগকেও ধর্মভীরু মুসলমানদের নিকট থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছিলো না, তখন গঠন করা হয় আওয়ামি মুসলিম লীগ। নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের রক্ষণশীল ডানপন্থী অংশটি সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল, তখন প্রগতিশীল অংশটি তার প্রতিক্রিয়াশীল পুরানো সংস্করণ থেকে মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি  উদার রাজনৈতিক অবস্থানের কথা ভাবে। ১৯৫৪  সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, রাজনীতিতে অধিকতর অসাম্প্রদায়িকিকীকরণের লক্ষ্যে  আওয়ামী মুসলিম লীগ  'মুসলিম' শব্দটি মুছে ফেলে এবং অধিকতর অসাম্প্রদায়িক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের এই অসাম্প্রদায়িক নৌকায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিকামী  মানুষেরা দলে দলে ওঠে এবং  স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত বিস্তৃত সকল সংগ্রামে বিপুল্ভাবে অংশ নেয়। বস্তুত, জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অনুভূতি থেকেই  জন্ম নিয়ে এবং  মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহান মানুষের  নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৎকালীন সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন,  ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং ষোলো ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়--  প্রত্যেকটি ঘটনাই  বাঙালির জাতীয় জীবনের এক একটি মাইলফলক । আর সেগুলো রচিত হয়েছিল  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই।এবং তা রচনা করতে গিয়ে বারবার গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। বাঙালি জাতি হারিয়েছে তার পিতাকে; কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে নিহত হয়েছেন জাতীয় চার নেতা। এতো বড়ো রাজনৈতিক ত্যাগ আর কোনো দলের আছে বলে আমাদের জানা নেই। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ জনগণের দল হিসেবে, শেখ মুজিবের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ  তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে  এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবের কারাভোগজনিত অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃতেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতি যেভাবে  লড়াই অব্যাহত রেখেছিলো  তার দৃষ্টান্ত  মানব ইতিহাসে বিরল।     

বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাছে আওয়ামী লীগের রয়েছে অপরিশোধ্য ঋণ। বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর দল, তাঁর দেশ এবং তাঁর জনগণের জন্যে  পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন । পাষাণ প্রাচীর এবং লৌহ গরাদ অতিক্রম করে একটি স্বাধীন দেশ স্থাপন করেছেন পৃথিবীর মানচিত্রে। তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে এক চতুর্থাংশই তিনি কাটিয়েছেন   কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে;  প্রায় তেরো বছর-- দিনের হিশেবে ৪৬৮২ দিন। সেই স্কুল জীবনে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিরোধের জের হিসেবে ৭ দিনের জেলখাটা থেকে শুরু হয় তাঁর কারাজীবন। তবে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ শুরু হয় তাঁর ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ছাত্র-মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার ‘অপরাধে’। অক্টোবর ১৯৪৯-এ বেশকিছু কালের জন্যে জেলে যান পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে এবং সেই কারাভোগ বিনা বিচারে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত চলমান থাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আবাঞ্ছিত বিলুপ্তির পর আবারো ছয় মাসের জেল খাটেন। অক্টোবর ১৯৫৮-তে আইয়ুব খান পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি করলে বঙ্গবন্ধু ১৪ মাসের জন্যে কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারও তাঁর জেল হয়। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বৈধ করতে আয়োজিত প্রহসনের  নির্বাচনের মাত্র দু সপ্তাহ আগে বঙ্গবন্ধুকে আবারো কারারুদ্ধ করা হয় চৌদ্দ দিনের জন্যে। ১৯৬৫ সালেও একবার জেল খাটেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করলে মিথ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দুই বছরেরও অধিককাল কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি  তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর জনমত সংগঠিত করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় নিশ্চিত করেন। তারপরেও ক্ষমতারোহণের পরিবর্তে তাঁকে আবারো ষড়যন্ত্র করে জেলে নেয়া হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। দীর্ঘ ৯ মাস বঙ্গবন্ধু  পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে কাল কাটান সীমাহীন দুর্ভোগে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তাঁর  কারাজীবনের চিরসমাপ্তি ঘটে। এভাবে বঙ্গবন্ধু যতো বেশি কারাভোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ ততো বেশি শক্তিশালী হয়েছে। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাত্রে নিজ  পরিবারের সাথে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধু।  দুই কন্যা--শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যাতীত তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে  নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই ভয়াল আগস্ট রাতের নৃশংসতার কোনো তুলনা হয় না যখন আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের ছেলে শেখ রাসেলও খুনিদের রোষানল থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশ ও জনগণের জন্যে বেঁচেছেন  এবং তাদের জ্ন্যে প্রাণ দিয়েছেন। এর চেয়ে বড়ো ত্যাগ আর কি হতে পারে? তবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অর্জন এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে তা কোনো নির্দিষ্ট দলের গণ্ডিতে পরিমাপ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু একজন দলীয় রাজনীতিবিদ হিশেবে তাঁর  রাজনৈতিক ম্যারাথন শুরু করেছিলেন এবং বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা হিশেবে সমাপ্ত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও  তাঁর  দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য অসামান্য অবদান রেখেছেন। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তিনি তাঁর রাজনৈতিক নৌকার হাল ধরে আছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঔরসজাত সন্তান হয়েও তাঁকে দেশ ছেড়ে সেচ্ছা-নির্বাসনে যেতে হয়েছিল ভিনদেশে। চেনা পৃথিবী হঠাৎ করে অচেনা হয়ে উঠেছিলো তাঁর কাছে। চিরচেনা মানুষগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো নিরাপদ দূরত্বে, হয়তোবা বিপদের গন্ধ আঁচ করে। সেই চরম প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিয়ে দেশ ও মাতৃকাকে পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন  প্রায় অর্ধযুগ পরে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র এক চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বিরামহীণ বর্ষণ আর মুহুর্মুহু  বজ্রপাত শেখ হাসিনাকে যেনো বোঝাতে চেয়েছিলো পঁচাত্তর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশের ঘোর  অমানিষার কথা। সেইদিন সেই দূর্গতিনাশিনীর সাড়ম্বর আবির্ভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির বন্ধ বাতায়ন যেনো খুলে যায়। গদিনসীন জেনারেল অবশ্য তাঁর আগমন বন্ধ করার নানান ফন্দি ফিকির করেছিলেন। কিন্তু দেশ এবং জনগণের প্রবল আকর্ষণের কাছে  আর সবকিছু যেন গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।

দেশে ফিরে শেখ হাসিনা স্বচক্ষে দেখলেন পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক অদ্ভুত বাংলাদেশ। যেখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। দেশ-বিদেশে উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ফরমান জারি করে জাতির পিতার খুনের বিচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শ্রাদ্ধ করে একেবারে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়া হয়েছে। জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শতশত সেনা কর্মকর্তাকে নির্বিচারে হত্যাকরে এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক শাসন কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। আর রাজনীতিবিদদের জন্যে  রাজনীতি কঠিন করে সেনা ছাউনিতে বসে নতুন দল গড়ে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির জন্ম দেয়া হয়েছে। সুবিধেবাদী আমলা, দুর্বৃত্ত রাজনীতিক এবং ভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনা-বিরোধী এক বিধ্বংসী রাজনীতির খেলায় মেতেছিলেন তৎকালিন সামরিক শাসকেরা।  শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল না ধরলে হয়তো ততোদিনে ক্লোন-করা  পাকিস্তান হতো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। 
 
নব্বুয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের পরও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী শক্তির কাঁধে চড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে  মসনদে বসে থাকে। তার পরও হাল ছাড়েননি শেখ হাসিনা। শক্ত হাতে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন আওয়ামী লীগের ব্যানারে। অবশেষে অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে একসময় শেখ  হাসিনার  হাত ধরেই নতুন বিজয় আসে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ১৯৯৬-এর ১২ জুন। দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায়  আসে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর আসন অলংকৃত করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।  দেশ ও দলের ভেতর-বাইরের অসংখ্য সঙ্কট মোকাবেলা করে তিনি বাংলাদেশকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। হেনরী কিসিঞ্জারের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন স্যাটেলাইট যুগের মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া এক গর্বিত দেশ। 

বাংলাদেশের এই অসামান্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন দৈবযোগে সংঘটিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এদেশের মানুষের স্বপ্নসাধ, অসংখ্যের শ্রম-ঘাম, আর একটি সুদক্ষ সরকারের নেতৃত্ব, বিশেষ করে সেই সরকার প্রধানের দৃঢ়তা, আন্তরিকতা, স্বাপ্নিকতা  দেশপ্রেম এবং জনবান্ধব রাজনীতি। সত্যিই আজ বাংলাদেশের উন্নয়নের উপাখ্যানে জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদানের জুড়ি মেলা ভার। শেখ হাসিনা আজ কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেলই নন, তিনি আজ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন-রাজনীতির রোল মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।  জরিপকারীরা ভুল বলেনি “শেখ হাসিনা তার দলের চাইতেও অধিক জনপ্রিয়। দুর্নীতিবাজ, সুবিধেভোগী, ভণ্ড ও কপট নেতাকর্মিদের কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী  দলকে নিয়েও অনেক সময় সমালোচনা হয়। কিন্তু কাউকে কখোনো জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা হারাতে দেখিনা। দিনের চব্বিশ ঘন্টার সিংহভাগ সময় যার কাটে দেশের ভাবনায় ও কাজে- তাঁর ওপর আস্থা হারানো কঠিন।  শেখ হাসিনা  তাঁর  অনুপম ব্যক্তিত্ব, গতিশীল চৌকস নেতৃত্ব, কর্মদক্ষতা, মেধা ও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে নিজ দলে নিজেকে বিকল্পহীন হিসেবে এবং দেশে ও দেশের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। চার দশকের অধিকাল ধরে  নিজের দলকে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে  চলেছেন। তাঁর দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে  আমৃত্যু পার্টিপ্রধান হিসেবে কাজ করে যাওয়ার ম্যান্ডেট দিয়েছে।

তবে শেখ হাসিনা ক্রমাগত প্রমাণ করে চলেছেন, তিনি কেবল তাঁর  দলের জন্যেই নয়, দেশের জন্যেও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু যেমন আওয়ামী লীগের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন; সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন এবং স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর  রক্ত ও রাজনীতির সুযোগ্য উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনাও তেমনি ষোল কোটি মানুষকে নিয়ে সবসময় ভাবছেন। ভয়াল করোনা- সংক্রমণের এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কালেও তিনি ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে রাতদিন দেশবাসীর ভালোমন্দের খোঁজ খবর রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। এই জায়গায় পিতা-পুত্রীর অবস্থান পরস্পরের পরিপূরক। আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন যে প্রাচ্যের বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে তার পেছনে কাজ করছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশবাসীর- তৎপরতা। এই তৎপরতার সাফল্য অনিবার্য।
 
আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং এখনও উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বিরামহীনভাবে উন্নয়নের জন্যে কাজ করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্রের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং শেখ হাসিনা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিতে সফল হয়েছেন এবং শেখ হাসিনা আমাদের সমৃদ্ধি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই দুই মহান নেতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও একটি অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের বিখ্যাত থিসিস “Political Parties in India” (লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে সম্পাদিত) উপমহাদেশের উনিশ এবং বিশ শতকের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনসমূহের বিবর্তনের সাথে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তঃসম্পর্কের একটা নির্মোহ ন্যারেটিভ উপস্থাপন করে। প্রফেসর রাজ্জাক দেখিয়েছেন যে  কংগ্রেস কিংবা মুসলিমলীগের মতো ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রকৃত সামগ্রিক রাজনৈতিক ইচ্ছার সাথে নিজেদের কার্যক্রমের সমন্বয় ঘটাতে পারে নাই।  এই বিশ্লেষণ প্রায় পূর্বাপর সকল রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। 

১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমের হাত ধরে শিক্ষিত ভারতীয় এবং ব্রিটিশ রাজের মধ্যে নাগরিক ও রাজনৈতিক সংলাপের জন্যে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার  প্রয়োজনীয়তা থেকে অনেকটা কিংস পার্টির মতো। ১৯০৬ সালে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টো-এর অনুমতি নিয়ে প্রভাবশালী মুসলিম রাজনীতিকেরা ব্রিটিশ ভারতে কেবলমাত্র মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিপ্লবী দার্শনিক এম. এন. রায়ের হাত ধরে ১৯২৫ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। আজন্ম দ্বন্দ্বমুখর এই দল ভারতবাসীর রাজনৈতিক স্পন্দন বুঝতে না পারায় অনেক বড়ো মাপের নেতৃত্ব পাওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে নাই। পাকিস্থান পিপলস পার্টি(পিপিপি) ১৯৬৭ সালে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আবির্ভূত হয় যা পরবর্তীতে অসার প্রতিপন্ন হয়। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কম্যুনিস্ট পার্টি, পিপলস পার্টি সবকটিই কোনো না কোনোও ভাবে রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা (Political resilience) ধরে রাখতে পারে নাই। জওয়াহারলাল নেহ্রু এবং ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতার নেতৃত্বধন্য ভারতীয় স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস এখন  ভারতবাসীদের নতুন স্বপ্ন দেখাতে পারছে না। পাকিস্তান সৃষ্টির নেতৃত্বদানকারী  মুসলিম লীগ রাজনীতির বিবর্তনে টিকে থাকতে না পেরে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কম্যুনিস্টদের শোষণহীন  সাম্যবাদী সমাজ নিখিল ভারতে এখনো ইউটোপীয়ই থেকে গেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তার পঁচাত্তর বছরের জীবনে রাষ্ট্রক্ষমতয় কিংবা বিরোধী শিবিরে কোথাও নিষ্প্রভ থাকে নি। জন্মসূত্রে যেমন  পাকিস্তানের চরম বৈষম্যবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের অনুমতির তোয়াক্কা না করে  প্রতিবাদের একটি  অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক  ফোরাম  হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো, পরবর্তীতে তেমনি জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা প্রতিফলনের দর্পণ হিসেবে কাজ করেছে এবং একধরণের রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করেছে। এর পেছনে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার ভূমিকা অগ্রগণ্য। সেই ক্ষুরধার দৃষ্টি নিয়ে প্রফেসর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন করেছেন এভাবে: “দেশপ্রেম যতো বিস্তৃতভাবেই সংজ্ঞায়িত হোক না কেনো, এটা সুস্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসতেন, যতোটা ভালোবাসতেন বাঙ্গালী জাতিকে।“ তাঁর ভাষায়: “Regardless of how broadly one can define patriotism, it is clear that Bangabandhu loved his own country just as much as he loved the nation of Bangladesh".  
 

আওয়ামী লীগ জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের জন্যে নিবেদিত  একটি রাজনৈতিক দল।  উদার গণতন্ত্র, প্রগতিবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত দলটি  জনগণের  এক শক্তিশালী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিশেবে এটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের এক বিকল্পহীন নির্ভরতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেশে এমন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চল নেই, এমন কোনো গ্রাম-পাড়া-মহল্লা কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশী ভুবনে এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে আওয়ামী লীগের কিংবা বঙ্গবন্ধুর সমর্থক নেই। এবং সেটাই আওয়ামী লীগের শক্তির গোপন কথা। প্রলয়ঙ্কর ঝড় তুলে হয়তোবা সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগের নৌকা বেহাল করা গেছে, কিন্তু তাকে কখনোই ডোবানো সম্ভব হয়নি। সেটাই আওয়ামী লীগের ইতিহাস। এর ভাবমূর্তি কখনো কখনো  কপট আওয়ামী লীগার এবং সুবিধাবাদী অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা ক্ষুণ্ণ  হয়।  দলীয় সম্পৃক্ততার সুযোগ নিয়ে তারা  বিভিন্ন ধরণের কুকর্ম  ও দুর্নীতির মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে। কিন্তু তারপরও বারবার মানুষ এই দলটির শরণাপন্ন হয়, কারণ এটি দেশের  বিশ্বস্ততম মুক্তিযুদ্ধপক্ষীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন। অনুপ্রবেশকারী ও সুবিধাবাদীদের দমন করা গেলে আওয়ামী লীগ আরো বেশি গণআস্থা অর্জন করতে পারবে। তা দলটির জন্যে যেমন ভালো, দেশের জন্যেও তেমনি ভালো।  বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য বস্তুত  আওয়ামী লীগের সাথে অঙ্গাঙ্গাীভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের জীবনীই হলো বাংলাদেশের ইতিহাস।

 (লেখক: ড. রাশিদ আসকারী: দ্বিভাষিক লেখক, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং প্রাক্তন উপার্চায , ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া)