ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

গুম-খুন-দখলের নেতৃত্বে ছিল যেসব সামরিক কর্মকর্তা

মানিক শিকদার

প্রকাশিত : ০৩:৫৫ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০২৪ সোমবার

আওয়ামী দুঃশাসনের গত ১৫ বছরে হত্যা-গুম আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের বিশেষ একটি অংশে নেতৃত্বে দিয়েছেন সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা। ইসলামী ব্যাংক থেকে একুশে টেলিভিশনের মতো জনপ্রিয় গণমাধ্যম। সবকিছু দখলে এস আলমের লাঠিয়াল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই। 

তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উত্থান ঘটেছে এস আলমদের। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অপশাসন থেকে মুক্তির পর অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের বিচার দাবি করেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা।

সদ্য চাকরিচ্যুত রিয়ার এডমিরাল এম সোহায়েল, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আকবর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার রাশিদুল আলম, মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান। এমন আরও বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় দেশ জুড়ে চলতে থাকে হত্যা-গুম-দখলদারিত্ব আর লুটপাটের রোমহর্ষক অধ্যায়।

সরাসরি তাদের নেতৃত্বেই উত্থান ঘটে ব্যাংক খেকো- জমি খেকো এস আলমের।  ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় আওয়ামী লীগের এই অলিগার্ক। এর দুই বছর আগে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর একইভাবে দখলে নেয় মুক্তচিন্তার খোলা জানালা হিসেবে পরিচিত সেই সময়ে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যম একুশে টেলিভিশন। গভীর এই ষড়যন্ত্রে সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি আব্দুস সোবহান গোলাপ।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই আটক করা হয় একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান এন্ড সিইও আব্দুস সালামকে। একের পর এক মিথ্যা মামলায় বিনা বিচারে জেল-হাজতের অন্ধ প্রকোষ্টে দীর্ঘ আড়াই বছর বন্দী রাখা হয় তাকে। তার একমাত্র অপরাধ- সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে গণমাধ্যমকে অবিচল রাখার প্রত্যয়।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মো. আহসানুল্লাহ (অব.) বলেন, “সরকার কর্তৃক মিডিয়াকে কুক্ষিগত করার যে প্রক্রিয়া সেটা কিন্তু ইটিভি দিয়ে শুরু হয়। তারা দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইলেকশন কমিশন, দুদক, সশস্ত্র বাহিনী এবং কিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্যাট্রোনাইজ করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।”

এস আলমের পক্ষে নগ্নভাবে কাজ করে যাওয়ায় মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সামান্য নৌ-কমান্ডার থেকে এম সোহায়েলের কপালে জোটে রিয়ার এডমিরাল পদ। একই সঙ্গে বনে যান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। ঐতিহ্যবাহী নৌ-বাহিনীর সোহাইল-ই একমাত্র কর্মকর্তা যিনি কোন জাহাজ বা ঘাটি কমান্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ কোন সামরিক কোর্স ছাড়াই রিয়ার এডমিরালের পদ বাগিয়ে নেন। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে লুটপাট করেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

সাবেক সেনাকর্মকর্তা মো. আহসানুল্লাহ বলেন, “এই সমস্ত কর্মকর্তারা আবার অনেক ব্যবসায়ীর নির্দোষ ছেলেপেলেদের ধরেও আটক রাখতো। বলা হতো- গুম করে দেওয়া হবে, খুন করা হবে টাকা দাও। সোহাইল ও জিয়াউল আহসানরা এগুলো করেছে।”

চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে এস আলমের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ৫ জন নিরস্ত্র গরীব খেটে খাওয়া মানুষকে হত্যার নেতৃত্বেও ছিলেন এই সোহায়েল। হত্যা-গুমসহ অসংখ্য ভয়ঙ্কর অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে করা হয়েছে চাকরিচ্যুত। 

সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল কামরুজ্জামান (অব.) বলেন, “আমাদের যে সরকার কাঠামো ছিল, যে সরকার ব্যবস্থাপনা ছিল সেটা তাদের নিজ স্বার্থে এবং আমাদের কতিপয় অফিসার যারা নিজেদের পেশাদারিত্ব ভুলে যেয়ে অন্যের কাজগুলো করেছে। সেই কাজগুলো করতে গিয়ে নিজেরা কিছু ব্যক্তিগত সুবিধাও গ্রহণ করেছে।”

প্রায় ছয় বছর ধরে ডিজিএফআই’র মহাপরিচালক পদে থাকা লেফটেন্যান্ট জেনারেল আকবর হোসেনও হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দু-দিন আগেই। তবে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের মূল হোতা র‌্যাবের তৎকালীন লেফটেনেন্ট কর্নেল রাশিদুল আলম। বিভিন্ন সময় হয়েছেন নানাভাবে পুরস্কৃত, হয়েছে অঢেল সম্পদের মালিক। কিন্তু এ ধরণের কথিত কিছু সামরিক কর্তাব্যক্তির কারণে পুরো বাহিনী বারবার বিতর্কিত হবে এমনটা মানতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। 

মো. আহসানুল্লাহ বলেন, “ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে তারা নিজস্ব ব্যক্তিস্বার্থ, নিজস্ব রাজনৈতিক অবিলাস চরিতার্থ করার জন্য। সেনাবাহিনীকে মানুষের কাছে হেয় করার জন্য হীন প্রচেষ্টা ছিল ওই সরকারের।”

কেবল চাকরিচ্যুতি, অব্যহতি কিংবা ওএসডি করা নয়, অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির কোন বিকল্প নেই বলে মত সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, এসব দুষ্কৃতকারীরা ভবিষ্যতে যাতে কোন অবস্থাতেই দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন।

লে. কর্নেল কামরুজ্জামান (অব.) বলেন, “আমি মনে করি যারা এই ধরনের কাজে সাথে সম্পৃক্ত থেকে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, সেই ভাবমূর্তি ফেরাতে এইসব অফিসারদের বিচার হওয়া উচিত। “

আগামিতে কোন সেনা সদস্য যেন বিশেষ কোন ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত না হন, তার নিশ্চয়তা বিধানেরও দাবি জানিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা।

এএইচ