ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৪ ১৪৩১

শূন্য থেকে অনন্তে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:৫২ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সোমবার

শূন্য! জীবনের শুরুটাই শূন্য। বাবা মারা গেলেন ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই। মা মারা গেলেন ছয় বছর বয়সে। আশ্রয়দাতা দাদা মারা গেলেন আট বছর বয়সে। চাচার কাছে নতুন করে আশ্রয় পেলেন। কিশোর বয়সেই কাজে নেমে পড়লেন। স্বল্প পারিশ্রমিকে তপ্তমরুতে গবাদি পশু চরানোর কাজ। অক্ষরজ্ঞান অর্জনের আর সুযোগ হলো না।

১২ বছর বয়সে প্রথম বাণিজ্যযাত্রায় অংশ নিলেন চাচার সাথে। চাচার ব্যবসায় থেকে লেনদেনে সততা, আপস-আলোচনায় কুশলতা আর পণ্য কেনাবেচায় দক্ষতা দিয়ে নজর কেড়ে নিলেন ঝানু ব্যবসায়ীদের। বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনা শুরু করলেন ২২ বছর বয়সে। সত্যবাদিতা ও ন্যায়নিষ্ঠার জন্যে পরিচিত হলেন আল-আমিন হিসেবে।

বিয়ে করলেন ২৫ বছর বয়সে। স্ত্রী ধনাঢ্য ও বিদূষী। দুবার বিধবা হয়েছেন। আগের ঘরের তিন সন্তান। তারপরও নিজের সবকিছু উজাড় করে দিলেন স্বামীর জন্যে। এক এক করে ঘর আলো করে এলো দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সুখের পয়মন্ত সংসার। অর্থবিত্ত, সুনাম ও সম্মানে পরিপূর্ণ জীবন। একজন সংসারী মানুষ যা চায়, সবকিছুই এসেছে কানায় কানায়।

কিন্তু তারপরও অপূর্ণতা। অন্তরে এক অব্যক্ত হাহাকার। চারপাশে জাহেলিয়াতের রাজত্ব। মক্কা তখন রমরমা অর্থনৈতিক কেন্দ্র। বেনিয়া অভিজাতরা মত্ত ভোগবিলাসে। তাদের লালসার আগুনে সাধারণ জীবন শুধুই বঞ্চনার, অসহিষ্ণুতার, হিংসার।

পূর্ণতার সন্ধানে নিজের ভেতরে ডুবে যেতে লাগলেন ঘন ঘন। খুঁজতে লাগলেন বঞ্চিতের মুক্তির পথ। সুযোগ পেলেই চলে যেতেন হেরা গুহায়। সেখান থেকে তাকিয়ে থাকতেন কাবার দিকে। কিন্তু ডুবে যেতেন অন্যলোকে। রমজানে পুরো মাসটাই কাটাতেন ধ্যানে। ৪০ বছর বয়সে তিনি প্রথম ওহী পেলেন। পেলেন লাঞ্ছিত মানবতার মুক্তির মন্ত্র; ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ!’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই আর মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল)।

মাত্র একটি বাক্য। শুধু একটি মন্ত্র। জীবন তাঁর বদলে গেল। বাক্যের শব্দমালা সাধারণ। কিন্তু অর্থের গভীরতা মহাসমুদ্রের। ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই’। অর্থাৎ তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো অংশী নেই। অর্থাৎ ঐশীবিধানই শুধু মানতে হবে। কোনো প্রাণী বা কল্পিত শক্তি উপাস্য হতে পারে না। এক স্রষ্টা সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। সব মানুষ সমান।

আর মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল। অর্থাৎ ঐশীবিধান এখন আসবে তাঁর মাধ্যমেই। শাশ্বত ধর্মের বাণী মানুষের কাছে তাঁকেই পৌঁছাতে হবে। বঞ্চিতের পক্ষে তাঁকেই দাঁড়াতে হবে। সত্যের পক্ষে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে হবে। সমাজকে বদলাতে হবে।

কঠিন কাজ। সরল ও নির্বিরোধ মানুষটি রাতারাতি হয়ে গেলেন প্রাজ্ঞ সমাজবিপ্লবী। বুঝলেন—বিশ্বাসের এই বাণী বেনিয়া-অভিজাত পুরোহিত চক্র মেনে নেবে না। তাই চেতনা বিস্তারের কাজ শুরু করলেন গোপনে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-স্বজন ও বঞ্চিত কিছু মানুষ তাঁর চেতনাকে গ্রহণ করলেন। চেতনা বিস্তারে শুরু করলেন সঙ্ঘবদ্ধ গোপন প্রচার। তিন বছর পর প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন সত্যধর্মের বাণী।

শুরু হল বিরোধিতা। শোষক অভিজাত শ্রেণি সত্যধর্মের মধ্যে দেখল তাদের সর্বনাশ। প্রথমে পাগল, ভণ্ড, জ্বীনে পাওয়া, মৃগী রোগী বলে হাসিঠাট্টা, ব্যঙ্গবিদ্রুপ। এরপর শুরু হলো নির্মম নির্যাতন। অনেককে হত্যা করা হলো। শত্রুর প্রচণ্ড হিংসার বিরুদ্ধে তিনি অবলম্বন করলেন অহিংস নীতি। অনুসারীদের একটি দলকে আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। নিজে অনুসারীদের নিয়ে শিবে আবু তালিবে তিন বছর একঘরে অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন।

সত্যধর্মের প্রচার কিন্তু বন্ধ হলো না। বিরোধী অভিজাতরা তখন তাঁকে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। রাতের অন্ধকারে তিনি জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করলেন।

কোরাইশরা মদিনায়ও তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিল না। হত্যা করার জন্যে আততায়ী প্রেরণ করল। ঘাতককে বিপুল পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিল। মদিনাবাসীকে দিল চরমপত্র। তিনি বুঝলেন, শান্তির জন্যেও শক্তি দরকার।

মদিনা রক্ষার জন্যে তিনি গঠন করলেন জনযোদ্ধার দল। মূল লক্ষ্য ছিল আত্মরক্ষা। কোরাইশদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলা। বাণিজ্যপথে জনযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ মক্কায় এক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করল। কোরাইশরা তাঁকে ধ্বংস করার জন্যে বদর, ওহুদ, খন্দক—তিন তিনটি অভিযান চালাল। কিন্তু তাঁর রণকৌশলের সামনে শত্রুর সকল অভিযান ব্যর্থ হলো।

মদিনায় এসেই তিনি ঘর গোছানোর কাজ শুরু করলেন। একজন শরণার্থী হয়েও প্রজ্ঞা ও কুশলী পদক্ষেপের মাধ্যমে মদিনায় হানাহানি বন্ধ করে গড়ে তুললেন কল্যাণ রাষ্ট্র। প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করলেন। নিশ্চিত করলেন ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকার। সাহাবীদের তৈরি করলেন স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্যে উৎসর্গীকৃত ত্যাগী যোদ্ধা হিসেবে। হুদায়বিয়ার চুক্তি তাঁকে প্রথমবারের মতো দিল শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপ্রচারের অধিকার।

সৃষ্টির প্রতি করুণার প্রতীক ছিলেন তিনি। রক্তপাতকে ঘৃণা করতেন। ইতিহাসে তিনি প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করলেন অহিংস রণকৌশল। কৌশলের মূলনীতি ছিল শক্তি নিয়ে অকস্মাৎ উপস্থিত হও। শত্রুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দাও। যুদ্ধ করার মনোবল ভেঙে দাও। তারপর আপস-আলোচনায় তাকে যুদ্ধ না করার সম্মানজনক সুযোগ দাও।

তাঁর অহিংস রণকৌশলের সার্থক উদাহরণ মক্কার মুক্তি (Liberation of Mecca)। জন্মভূমি মক্কাকে তিনি মুক্ত করলেন, পৌত্তলিকতার অবসান ঘটালেন বিনা রক্তপাতে। চরম নির্যাতনকারীদেরও তিনি ক্ষমা করে দিলেন। কট্টর শত্রুদের রূপান্তরিত করলেন তাঁর সমাজ বিপ্লবের সৈনিকে।

বিস্ময়কর ঐতিহাসিক সত্য হলো, হিজরত থেকে মক্কার মুক্তি পর্যন্ত—সবগুলো যুদ্ধ-সংঘাতে উভয়পক্ষে নিহতের সংখ্যা পাঁচশরও কম। আপস-আলোচনার মধ্য দিয়েই তিনি ছাই থেকে পত্তন করেন নতুন এক কল্যাণ রাষ্ট্রের। হাজার বছর ধরে গোত্রীয় কোন্দল ও হানাহানিতে লিপ্ত শত শত গোত্রের মানুষদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন এক উম্মাহ। আর তাঁর সাহাবীরা এই উম্মাহকে নিয়ে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের হাজার বছরের শোষণের অবসান ঘটান। গড়ে তোলেন এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা।

আলোকোজ্জ্বল এই নতুন সভ্যতার ভিত্তি ছিল তাঁর জীবনাচার। তাঁর জীবন ছিল তাঁর বাণীরই মূর্ত প্রতীক। হাদীস নামে পরিচিত তাঁর বাণী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনুপ্রাণিত করে এসেছে সত্যানুসন্ধানীদের। যিনিই মুক্তমনে সত্য অনুসন্ধান করেছেন, তিনিই বিস্মিত, মুগ্ধ হয়েছেন এই বাণীর কালজয়ী রূপ দেখে। জীবন বিশ্লেষণের গভীরতা দেখে। মানবিকতার জয়গান দেখে। নির্মল সত্যের প্রকাশ দেখে। মানবকে মহামানবে উন্নীত করার আকুতি দেখে। তাঁর বাণী সেকালের মতো একালেও সমভাবে অনুসরণীয়। তাঁর বাণী শুধু আধুনিকই নয়; বরং উত্তরাধুনিক।

প্রিয় পাঠক! ‘হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী’ তাঁর পবিত্র বাণীর শাব্দিক অনুবাদ নয়, তাঁর কিছু বাণীর বাংলা মর্মান্তর। সহজ সাবলীল এই মর্মান্তর আপনার অন্তরে সৃষ্টি করবে এক অভাবিত অনুরণন। ক্ষণে ক্ষণেই আপনি শিহরিত হবেন আপনার জীবনে এ বাণীর প্রাসঙ্গিকতায়। মনে হবে—আপনাকেই যেন কথাগুলো বলছেন তিনি। তাই পড়া শুরু করুন যে-কোনো পাতা থেকে। ডুবে যান বাক্যের গভীরে। আপনি পাবেন পথের দিশা। জীবন বাঁক বদলাবে। আপনার উত্তরণ ঘটবে উচ্চতর মানবে।

গ্রন্থসূত্রঃ হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী

 

এসবি/