আবারো ক্ষমতায় ফেরার কৌশল আঁটছে বিতাড়িত রাজনৈতিক পরিবারটি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০১:৩৪ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মঙ্গলবার
উচ্ছ্বসিত যুবকরা একটি পুলের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস করছে। কেউ একজন গায়ে সাবান মেখে মেতে উঠেছেন উচ্ছ্বাসে। শ্রীলঙ্কানরা সুসজ্জিত হলের মধ্যে নাচছে, সেখানে কেউ ব্যান্ড বাজাচ্ছে, কেউ নাচছে ভেঁপুর সুরে সুরে। ২০২২ সালের ১৩ জুলাইয়ের এই দৃশ্যগুলো সারা বিশ্বে এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। যখন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করেছিল। রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসাকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।
এটা ছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের জন্য বিজয়ের মুহূর্ত।
এর আগে আন্দোলনে শ্রীলঙ্কা জুড়ে কয়েক লাখ মানুষ সরকার ঘোষিত কারফিউ অমান্য করেছিল। টিয়ার গ্যাস, জল কামান উপেক্ষা করে তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
মি. রাজাপাকসা আন্দোলনের সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলনকারীদের পদত্যাগের আহবানকে উপেক্ষা করেছিলেন। যদিও জনগণের ক্ষোভ কমাতে তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসা আগেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কয়েক মাস ধরে চলা এই বিক্ষোভকে সিংহলী ভাষায় বলা হয় ‘আরাগালয়’। যার অর্থ সংগ্রাম। এই আন্দোলন জুলাইয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়, তীব্র আন্দোলনের মুখে গোটাভায়া রাজাপাকসার দ্রুত ও অপমানজনক পতন হয়েছিল।
অথচ, মাত্র কয়েক মাস আগেও এমন ঘটনা ছিল কল্পনাতীত।
বছরের পর বছর ধরে রাজাপাকসা পরিবার মাহিন্দা রাজাপাকসা নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ছিল।
প্রথম মেয়াদে মাহিন্দা রাজাপাকসা তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত সমাপ্তির নেতৃত্ব দেন। এই বিজয়ের পর দ্বীপরাষ্ট্রটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী তাকে দেশের ত্রাণকর্তা ভাবা শুরু করে।
পরে তিনি ক্ষমতাবান হতে লাগলেন সেই সাথে তার পরিবারও। তিনি তার ছোট ভাই গোটাবায়াকে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই পদে বসে তিনি নানা নির্মম কাজ করেছিলেন বলে সমালোচনা রয়েছে।
তার অন্য দুই ভাই বাসিল এবং চামাল ছিলেন যথাক্রমে অর্থমন্ত্রী এবং সংসদীয় স্পিকারের দায়িত্বে।
পরিবারটি বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেছে; দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দুঃশাসন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভিন্নমত দমনের অভিযোগে অভিযুক্ত।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন হয়। কিন্তু তার আগে সরকারের কয়েকটি নীতির কারণে দেশটিতে চরম অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়।
মাহিন্দা প্রথম রাষ্ট্রপতি হওয়ার সতেরো বছর পর, শ্রীলঙ্কার জনতা রাজাপাকসার পতন উদযাপন করেছিল। কারণ তারা জানতো একজনের পতন মানেই পরিবারটির রাজত্বও শেষ।
কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়েছে?
দুই বছর পর মাহিন্দা রাজাপাকসার ছেলে নামাল রাজাপাকসা ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লক্ষণ সান্দারুয়ান বিবিসি সিনহালাকে বলেন, “এটা যথেষ্ট খারাপ যে গণবিক্ষোভের পর যারা বিতাড়িত হয়েছিল তারা এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এমনকি ভোটারদের কেউ কেউ সেই পরিবারের একজন সদস্যকে ভোটও দিতে পারে।”
নামালই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি দৃশ্যপটে ফিরে এসেছেন।
গোটাবায়া রাজাপাকসা নিজেও বিক্ষোভের মুখে দেশ ছাড়ার পর বেশিদিন দূরে থাকেননি।
ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র ৫০ দিন পর সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর, তাকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল।
সেই সাথে পেয়েছিলেন একটি বিলাসবহুল বাংলো এবং নিরাপত্তা। যার ব্যয়ভার রাষ্ট্রই বহন করে।
রাজাপাকসার মেয়াদের বাকি দুই বছরের জন্য বিরোধী রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এসএলপিপি তার পিছনে তাদের সমর্থন দিয়েছিল।
অপ্রত্যাশিত ক্ষমতা গ্রহণের আগে বিক্রমাসিংহে ছিলেন ছয় বারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি রাজাপাকসা পরিবারকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। ওই পরিবারকে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করারও অভিযোগ রয়েছে বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে। যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিক্রমাসিংহে রাষ্ট্রপতি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে কলম্বোর গল ফেস-এ ভিড় সামলাতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। যা ছিল বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল।
“রনিল বিক্রমাসিংহে রাজাপাকসা পরিবারকে জনগণের তীব্র ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। এসএলপিপি-এর নেতৃত্বাধীন সংসদ, মন্ত্রিসভা এবং সরকারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছেন এবং দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য কিছুই করেননি। এমনকি রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্তের অগ্রগতি করেননি,” বলছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জয়দেব উয়াঙ্গোদা।
এখন শ্রীলঙ্কায় যদিও বিদ্যুতের ঘাটতি নেই তবে দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। সরকার বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিতে ভর্তুকিও বাতিল করেছে এবং কল্যাণ ব্যয় কমিয়েছে। এদিকে, কর বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ বিক্রমাসিংহে করের হার দ্রুত বৃদ্ধি করেছেন।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেছেন যে শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে কঠিন কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল। সেটি না করায় লাখ লাখ লঙ্কানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
যেমন মানুষ ক্ষুধার্ত হয়েছে, অর্থনৈতিক সংকট হয়েছে, অনেকে তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
রাজাপাকসারা তাদের অপরাধ অস্বীকার করলেও ২০২৩ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে গোটাবায়া এবং মাহিন্দাসহ এই পরিবারটি ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নানা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য সরাসরি দায়ী ছিল। যা সংকটের সূত্রপাত করেছিল।
নামাল রাজাপাকসা নিজেকে পরিবর্তনের দূত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। কিন্তু অনেকেই তার প্রার্থিতাকে তার বিতর্কিত পরিবারের ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
নামাল রাজাপাকসার নির্বাচনি প্রচারণা তার বাবা মাহিন্দা রাজাপাকসার উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে। মাহিন্দাকে এখনও কিছু লঙ্কান নায়ক হিসেবে দেখেন।
মাহিন্দা রাজপাকসার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ জাতিসংঘ আগেই করেছে। জাতিসংঘ মনে করে যে ৪০ হাজার তামিল বেসামরিক ব্যক্তিসহ অন্তত এক লাখ মানুষ শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল।
কিন্তু মাহিন্দা রাজাপাকসা কখনোই এসব ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হননি এমনকি এই ধরনের অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নামাল রাজপাকসার নির্বাচনি প্রচারণায় মাহিন্দার ছবি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টেও ছোটবেলায় বাবার সাথে নামালের ছবি প্রচার করছেন কেউ কেউ।
তিনি এমনকি একে অপরের সাথে তাদের সাদৃশ্য হাইলাইট করার চেষ্টা করেছেন, তার গোঁফ বাড়িয়েছেন এবং মাহিন্দার ট্রেডমার্ক লাল শাল পরেছেন।
নামালের নির্বাচনি প্রচারণামূলক কোনো কোনো পোস্টে এটাও বলা হচ্ছে যে, “আমরা কোনো চ্যালেঞ্জকে ভয় পাই না, আমরা সবার বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। এটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি।”
অন্য একটি পোস্টে মাহিন্দা রাজাপাকসাকে “দেশপ্রেমিক, সাহসী এবং দূরদর্শী” হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নামালের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি প্রচারাভিযান পোস্টে একটি নেতিবাচক মন্তব্য ছিল “রাজাপাকসা পরিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রপতি পদে কেন ভোট করছে, এটি পারিবারিক ব্যবসা তাই না?”
তবে, মাঠ পর্যায়ে এই প্রতিক্রিয়া ছিল আরো ভয়াবহ।
“আমি কখনই নামাল রাজাপাকসাকে ভোট দেব না। আমরা যে কষ্টের সময় পার করেছি, সেটি হয়েছে রাজাপাকসা পরিবারের কারণেই,” এইচএম সেপালিকা নামক একজন গ্রামবাসী বিবিসি সিংহলাকে বলেছিলেন।
“এ দেশের মানুষ এক হয়ে এই সংগ্রাম করেছে কারণ তারা রাজাপাকসাদের চায়নি। কিন্তু তাদের এখনও ক্ষমতার জন্য এত লোভ যে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করছে এবং জনগণকে তাদের জন্য ভোট দিতে বলছে,” বলছিলেন হাম্বানটোটার একজন দোকান সহকারী নিশান্তি হারাপিটিয়া।
শ্রীলঙ্কার এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনোযোগ মূলত তিন প্রার্থীকে ঘিরে
বিরোধী নেতা সজিথ প্রেমাদাসা, বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পার্টি জোটের অনুরা কুমারা দিসানায়েক এবং বিক্রমাসিংহে, যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তবে নামাল রাজাপাকসা আরও দীর্ঘমেয়াদী খেলা খেলতে পারেন।
কারণ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, একসময়ের অজনপ্রিয় শক্তিশালী ব্যক্তিদের পরিবার বা মিত্ররা পরে আবার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন করে থাকে। যেমন ফিলিপাইনের বোংবং মার্কোস কিংবা ইন্দোনেশিয়ার প্রবোও সুবিয়ান্টোর পরিবার।
“তিনি এসএলপিপির ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখতে চান এবং ২০২৯ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকতে চান,”, বলছিলেন অধ্যাপক উয়াঙ্গোদা।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লক্ষণ সান্দারুয়ানও এই বক্তব্যে একমত।
তিনি বলেন, “নামাল ২০২৯ সালের নির্বাচনকে টার্গেট করে মূলত এবারের ভোটের মাঠে আছেন। এবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য নয়।”
"কিন্তু জনগণ যদি বুদ্ধিমান না হয়, তাহলেই শুধু আবার রাজাপাকসাকে রাষ্ট্রপতি বানাবে।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/