পুলিশ সংস্কারে একগুচ্ছ প্রস্তাব রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:০২ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:৩৯ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার
পুলিশ সংস্কারে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। আজ মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার' শীর্ষক এক আলোচনা সভা এসব প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সামজীর আহমেদ।
সভায় বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বেশকিছু স্পটে পুলিশ বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। নিয়মবহির্ভূত প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এজন্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশের গুটি কয়েক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাই দায়ী। অথচ যার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক চাপে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত কাউকে দুই বছরের আগে বদলি করা যাবে না। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা যে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির মৌখিক, লিখিত বা টেলিফোনে সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
এছাড়া ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে তা আইনসঙ্গত ছিল কি না তা তদন্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এসব ক্ষেত্রে খসড়া প্রস্তাবে ১১ সদস্যের জাতীয় পুলিশ কমিশন, ৫ সদস্যের স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ কর্তৃপক্ষ এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে দ্রম্নত সাজা দেওয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক, গবেষক, আইনজীবী ও পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা।
সভায় সাবেক আইজিপি ড. এনামুল হক লিখিত বক্তব্যে বলেন, পুলিশ আইন ও পিআরবির অসামঞ্জস্য দূর করতে হবে। ওসি নিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশের আর্থিক হিসাব-নিকাশ এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যারা এখনো যোগদান করেনি দ্রুত নোটিশ করে তাদেরকে চাকরিতে যোগদানের তাড়া দিতে হবে।
অধ্যাপক সামজীর বলেন, বাংলাদেশের পুলিশ চলে ব্রিটিশ উপনিবেশের তৈরি করা আইনে। তাই এই পুলিশ বারবারই জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় এবং জুলুমের বাহিনীতে পরিণত হয়। তিনি পুলিশের নাম ও পোশাক পরিচ্ছদ পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি পুলিশের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ফিডব্যাকের ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব করেন তিনি। সেইসাথে পুলিশকে জনগণের রেগুলার সমস্যার ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানোর জন্য ইমেইল ও অনলাইনের ব্যবস্থা থাকারও প্রস্তাব করেন।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আত্মদান আমাদেরকে প্রজা থেকে নাগরিকে উন্নীত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যেই সুযোগগুলো আমরা চাই রাষ্ট্রের কাছে, মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার জন্য সেগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। বিগত সময়ে পুলিশসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, বিরোধীমত দমনসহ সকল অপকর্মই করেছে। সর্বশেষ আমলে যারা দ্রুত প্রমোশন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে তাদের ব্যাপারে দ্রুত তদন্ত করে জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।
সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, বিরোধীদলে থাকার সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন র্যাব বাতিল করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে উনি ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাবকে ব্যবহার করেছেন। ২০ হাজার পাবলিক সার্ভেন্টকে ঠিক করতে পারলে বাংলাদেশ ঠিক হয়ে যাবে। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে বাংলাদেশ সংস্কার অর্থবহ হবে না।
অধ্যাপক নিজার বলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বিগত ১০০ বছরে এতো হত্যাকাণ্ড এমনকি উপনিবেশ আমলেও হয়নি। নতুন রাষ্ট্রের মেটাপ্রিন্সিপাল হওয়া দরকার মানবিকীকরণ প্রক্রিয়া। সেই অনুযায়ী সকল উপনিবেশিক এবং পরবর্তী আইন-কানুন সংস্কার করা দরকার। আমরা দ্রুতই সকল উপনিবেশিক আইনের জুলুমের ধারাগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করবো।
অধ্যাপক মারুফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ যতো রকম অপরাধ নির্মুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রায় সকল অপরাধের সাথে পুলিশ নিজে জড়িত হয়ে পড়েছে। উলটো মানুষ আইনি সহযোগিতা পেতে চাইলে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের তাৎক্ষণিক কাজ হচ্ছে, যারা চাকরিতে আছেন তাদের স্ক্রিনিং করা, তারা সৎ কিনা, কর্মক্ষম কি না ইত্যাদি। নৌ বাহিনি, বিমান বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদ্য অবসর প্রাপ্তদের পুলিশে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা যেতে পারে।
ওয়ালিউল্লাহ বাশার বলেন, পুলিশী সংস্কার করতে হলে বিভিন্ন মেয়াদি সমাধান নিয়ে আলাপ করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কার উদ্যোগের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগও নেয়া দরকার। পাশাপাশি শহীদদের ব্যাপারে আমরা যেমন সহানুভূতিশীল তেমনি পুলিশের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন তাদের ব্যাপারেও সহানুভূতিশীল হতে হবে।
আইন গবেষক রাশেদ রাহম বলেন, আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে সম্মতির ভিত্তিতে বলপ্রয়োগ এর প্রতিষ্ঠান। এই বলপ্রয়োগকে ব্যালেন্স করার জন্য রাষ্ট্রে গণতন্ত্র দরকার। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে পুলিশকে খুনি বাহিনী হিসেবে জনগণের বিরুদ্ধে দাড়া করিয়ে দেয়া হয়েছিল। এগুলোকে আমলে না নিয়ে সংস্কার করা যাবে না।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, শুধু পোশাক পরিচ্ছদ ও নাম পরিবর্তন করলে তো নয়ই এমনকি শুধু পুলিশ সংস্কার করলেও হবে না। আমাদেরকে প্রধানত শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, নয়তো কোনো সংস্কারই টিকবে না। ৩ লেভেলে ভর্তির বদলে পুলিশে ২ লেভেলে ভর্তির প্রস্তাব করেন তিনি।
আলোচনা সভায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম সভাপতিত্ব করেন।
এসএস//