লেবাননে কতবার আক্রমণ করেছে ইসরায়েল, ফলাফল কী?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১১ এএম, ৫ অক্টোবর ২০২৪ শনিবার
প্রতিবেশী দেশ লেবাননে স্থল আক্রমণ শুরু করেছে ইসরায়েল। এর আগে দেশটিতে একের পর এক বোমা হামলা ও সেখানে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে অভিযান চালায় ইসরায়েল। তবে এমন আক্রমণের কোনো ঘটনা এবারই প্রথম না। আগেরবারের ঘটনাগুলোতে মিশ্র ফলাফল এসেছে।
এবারের আক্রমণ কি আগের আক্রমণগুলোর চেয়ে ভিন্ন ফলাফল আনতে পারে?
১৯৭৮: প্রথম আক্রমণ
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে লেবানন। সেই শরণার্থীদের মধ্যে পিএলও’র মতো ফিলিস্তিনি মিলিশিয়াও ছিল।
এই মিলিশিয়ারা লেবানন থেকে ইসরায়েল আক্রমণ করে দেশটিকে সংঘাতের দিকে টেনে নেয়। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো লেবাননে আক্রমণ করে ইসরায়েল।
তখন সমুদ্রপথে এসে একটি বাস জব্দ করে আধাসামরিক গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও)। তাতে ৩৮ জন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, যা ইসরায়েলে 'কোস্টাল রোড গণহত্যা' নামে পরিচিত।
এর জবাবেই আক্রমণ চালায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননে যাওয়ার দুই মাস পর সেখান থেকে সরে যায়। প্রতিবেশী দেশের মধ্যেই তারা একটি 'বাফার জোন' তৈরি করে সেখানে ২০০০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে।
এই আক্রমণে লেবাননে দুই হাজার যোদ্ধা ও বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের ১৮ জন সেনা নিহত হয়।
১৯৮২: সবচেয়ে বড় আক্রমণ
ইসরায়েল দেশটিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন চালায় ১৯৮২ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়।
শত শত ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যানসহ হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা সীমান্ত অতিক্রম করে। এবারও তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পিএলওকে হটানো, যারা লেবানন থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিল।
ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য ছিল পিএলও'র অবস্থানকে লক্ষ্যবস্তু করা যাতে তারা ইসরায়েলে আক্রমণ বন্ধ করে।
ইসরায়েলের বাহিনী একাধিক ফ্রন্টে অনুপ্রবেশ করে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
আক্রমণের সময় ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ওপর গণহত্যা চালায় ইসরায়েলি সেনারা।
লেবাননের মধ্যে একটি 'বাফার জোন' তৈরি করে তিন মাস পর ইসরায়েলিরা ফিরে আসে।
এবারের আক্রমণে লেবাননে ২০ হাজার মানুষ নিহত হয় যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। আর ইসরায়েলের ৬৫৪ জন সেনা নিহত হয়।
১৯৯৬: একটি নতুন শত্রু ও একটি নতুন আক্রমণ
১৯৮২ সালের আক্রমণে পিএলওকে স্থানচ্যুত করতে সফল হয় ইসরায়েল। এর ফলে লেবানন থেকে তিউনিসিয়াতে সদর দফতর সরিয়ে নেয় তারা।
কিন্তু এরপরে আক্রমণাত্মক আধাসামরিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ গড়ে ওঠে। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলকে তার শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে আক্রমণের চেষ্টা করে।
হিজবুল্লাহর রকেট হামলার জবাবে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলি বাহিনী প্রথমবারের মতো তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। হঠাৎ চালানো এই আক্রমণ মাত্র দুই সপ্তাহের একটি অপারেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আবারও বেসামরিক নাগরিকরাই ক্ষতির মুখে পড়ে। লেবাননের দিক থেকে ১৩ জন হিজবুল্লাহ যোদ্ধা ও ২৫০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হলেও ইসরায়েল কোনো মৃত্যু দেখেনি।
ইসলামি গোষ্ঠীদের রকেট নিক্ষেপ আর ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর বোমা হামলার মতো বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত থেকেই যায়।
২০০৬: যুদ্ধের ৩৪ দিন
এরপর আসে ২০০৬ সালের জুলাই মাস। সীমান্তের ওপারে ইসরায়েলি শহরগুলোতে গোলাবর্ষণের পাশাপাশি হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে এবং দুটি সামরিক গাড়িতে হামলা চালায়। সেখানে আটজন সেনাকে হত্যা এবং দুইজনকে জিম্মি করে তারা।
জবাবে লেবাননজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা এবং আর্টিলারি ফায়ার চালায় ইসরায়েল। একইসঙ্গে বিমান ও নৌ অবরোধ করে দক্ষিণ লেবাননে স্থল আক্রমণ করে।
লেবাননে প্রায় ১ হাজার ১৯১ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক। আর ইসরায়েলের দিকে ১২১ জন সেনা এবং ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
সামরিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনের মতে হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ আপাতত দুই দেশের মধ্যকার ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছে: “আমেরিকান ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল হেজবুল্লাহ সংগঠনের শিরচ্ছেদ করেছে, তাদের অর্ধেক অস্ত্র ধ্বংস করেছে এবং লেবানন আক্রমণ করেছে।”
ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক ইয়োভ স্টার্ন বিবিসিকে বলছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ১৯৮২ সালের মতো ব্যাপক সেনা মোতায়েনের বিপরীতে এবারও ২০০৬ সালের মতো কৌশল নিয়ে এগোবে ইসরায়েল।
“এটি একটি ধীর, সতর্ক এবং হিসাব করা আক্রমণ হবে, যেখানে প্রধান অক্ষে দ্রুত ও ব্যাপক আক্রমণের পরিবর্তে দক্ষিণ লেবাননের একের পর এক শহর দখল করা হবে,” বলেন স্টার্ন।
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ লেবাননের শহরগুলোতে হেজবুল্লাহ দীর্ঘকাল ধরে অবস্থান করছে। যার ফলে ইসরায়েলের এই শহরগুলো দখল করে দ্রুত ছেড়ে যেতে পারার সম্ভাবনা কম।
তবে হামাসের সাতই অক্টোবরের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলের হামলা এবং এবারের লেবানন আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
হেজবুল্লাহর অবকাঠামো এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সফল আক্রমণ সত্ত্বেও লেবাননের দৃশ্যপট অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং প্রমাণিত হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আমিন সাইকাল বলেন, “হেজবুল্লাহ হামাস না: ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা এখনও বেশ ভালোভাবে সশস্ত্র এবং কৌশলগতভাবে স্থাপিত।”
“গোষ্ঠীটি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিরোধ চালাতে সক্ষম হবে। এটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য চড়া মানবিক এবং বস্তুগত মূল্যের হতে পারে,” ব্যাখ্যা করেন তিনি।
জেরেমি বোয়েন উল্লেখ করেছেন যে ইসরায়েল এখনও গাজা অভিযানে তার প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটিও অর্জন করতে পারেনি।
“যতদূর জানা যায় দক্ষিণ লেবাননে হেজবুল্লাহর বিশাল টানেল নেটওয়ার্ক এবং সুবিধা রয়েছে। গাজায় প্রবেশ করার সময় তাদের সামরিক উদ্দেশ্যগুলোর একটি ছিল হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা আর প্রায় এক বছর পরেও তারা সেটা করেনি।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/