ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৫ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ৩০ ১৪৩১

যেভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক মানিক

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৩:২০ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:২৪ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ মঙ্গলবার

সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) সাবেক সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এলাকায় বোমা মানিক হিসাবে পরিচিত। নানা অপকর্ম চালিয়ে তিনি গত ১৫ বছরে গড়ে তোলেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি।

এমপি মানিকের ছত্রছায়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, বোমা মেশিন দিয়ে রাতের আধারে যত্রতত্র অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সরকারি খাল দখল, পাহাড় কাটা, আবাদি জমির টপ সয়েল কাটা, ছোট-বড় শতাধিক পাহাড় কেটে বন উজাড়, চোরাচালন, নৌ-পথে চাঁদাবাজিরসহ  নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে শুধু গায়ের জোরে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছিল অবাধে। 

মানিক অনুসারীরাই এসব নৈরাজ্যে নেতৃত্ব দেন। তারা কখনো সরাসরি এমপির নামে, কখনো বা তার নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম চালান। যে কারণে সাধারণ মানুষ এসবের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক মিয়া ও উপজেলা যুবলীগের লায়েকও খুন হয়েছেন। 

উল্লিখিত অপকর্মের নেপথ্যে রয়েছেন এমপির ও চাচাতো ভাই খুরমা উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল আহমদ, তার ভাতিজা (ড্রেজার তানভির আহমদ), সিমেন্ট খানার সিবিএ নেতা আজিজুর রহমান, পিএস মুশাহিদ আলী ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাহাদাত লাহিন, সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান লিপি বেগম, আওয়ামী লীগ আহবায়ক সৈয়দ আহমদ, আউয়াল,ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ আলম, সুন্দর আলী, আওলাদ মাষ্টার, আবু বক্কর, গয়াস আহমদ, আব্দুল খালিক ও আব্দুল হকসহ শতাধিক নেতাকমীরা শুন্য থেকে কোটি কোটি টাকা মালিক হয়েছেন। 

শত একর জমি, খাল বিল হাওর জায়গা দখল করে মাছের খামার, বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ি, দেশ-বিদেশে একাধিক আলীশান বাড়ি রয়েছে।  একসময় যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল, তিনি হয়ে ওঠেন রাজকীয় জীবনের অধিকারী। ‘আলাদিনের চেরাগ পাওয়া’ এই ব্যক্তির নাম হচ্ছেন এখন মানিক। 

স্থানীয় সাবেক পকিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের ওপর ভর করেই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এসব সম্পদ গড়েছেন এমপি মানিক। তার এসব অপকর্মের বৈধতা দিতে উপর মহলকে ম্যানেজ এবং রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় সরকারি রাজত্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা মাদক, চিনি ও ইয়ারা ও হুন্ডি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন তার ভাই মিজানুর রহমান হিরা।

জানা যায়, উপজেলার উত্তর খুরমা ইউপির আমেরতল গ্রামের মৃত কদমদর আলীর ছেলে মুহিবুর রহমান মানিক। গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন মানিক। তিনি ১৯৯০ সালে ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেই সুবাদে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। 

এরপর তার পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। তিনি ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ নির্বাচনে পরপর এমপি নির্বাচিত হন।  মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে তিনি হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক।

তার বিত্ত-বৈভবের উত্থান দেখে মনে হবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি পেয়ে বসেছিলেন আলাদ্দীনের চেরাগ। রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি রাজনীতির মাঠে হয়ে উঠেন মাফিয়া ডন।  এভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি তার নির্বাচনি এলাকা ছাতক -দোয়ারাবাজার, সিলেট, ঢাকাসহ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন আবাদী জমি, বিভিন্ন ধরনের বাগান, ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় বাড়ায় সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে  ৪ বারের এমপি মানিকের। 

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় উল্লেখ করেন ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে ৬ হাজার টাকা এবং ব্যবসা থেকে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বার্ষিক আয় করতেন তিনি। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামা অনুযায়ী বার্ষিক আয় ৫২ লাখ ৭০ হাজার ৮৬৬ টাকা। সেই হিসাবে গত ১৫ বছরে আয় বেড়েছে ২১ গুণেরও বেশি। 

সম্পদশালী না হলেও গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি অবৈধ পন্থায় হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে গড়েছেন বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ব্যাপক সম্পদ।

নিয়োগের নামে ঘুষ বাণিজ্য: উপজেলার সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে কয়েক কোটি টাকা নেন। তার হাত থেকে বাদ যায়নি স্কুল, কলেজ, দাখিল মাদ্রাসা। লাকেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়সহ দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠানে এমপিও ভুক্ত নামে সিন্ডিকেট করে তিন শতাধিক শিক্ষক কর্মচারি, দপ্তরি ও আয়াসহ জনবল নিয়োগে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

২০১৯ সালে তার দুর্নীতি লুটপাটের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নির্দেশে অনুসন্ধান শুরু করলেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তদন্তের আলো মুখ দেখেনি। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি মুহিবুর রহমান মানিককে (ওরফে বোমা মানিক) গ্রেপ্তার করা করেছে র‌্যাব। গত ৮ অক্টোবর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সুনামগঞ্জ সদরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে গত ২ সেপ্টেম্বর একটি মামলা দায়ের করেন। 

এ মামলায় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাবেক তিন এমপিসহ ৯৯ জনকে আসামি করে। এ মামলায় মুহিবুর রহমান মানিককে গ্রেপ্তার করেছেন র‌্যাব।

এএইচ