নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে পিষ্ট জীবন, স্বস্তি মিলবে কবে?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১১ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:১৩ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার
বিগত সরকারের সময়ে বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে যে লুটপাট করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এমন কিছু থাকবে না বলেও মানুষ মনে করছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছেই এখনো জিম্মি বাজার। চাল, ডাল, চিনিসহ প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বছরজুড়েই ভুগিয়েছে ক্রেতাদের। নতুন সরকার আসার পর এসব পণ্যের দামে খুব একটা হেরফের হয়নি। দাম কমাতে সরকারের তরফে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। কমানো হয় কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক। শুল্ক কমালেও এসব পণ্যের আমদানি বাড়েনি। দামও কমেনি। ফলে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের চাপে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি মিলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে আরও বছর খানেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। আসছে জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। তবে তাতে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে উল্টো চিত্রও আছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের কারও কারও কথায় হতাশ ক্রেতারা।
রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন আকিল উদ্দিন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। জীবনযাত্রা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুই বছর ধরে একই বেতন পাচ্ছি। কিন্তু এই সময়ে খরচ বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ। এখন প্রয়োজনীয় অনেক কিছু বাদ দিয়ে চলতে হচ্ছে। ছয় মাস আগে বাসা বদল করেছি ভাড়া কমানোর জন্য। নিত্যপণ্যের দামের কারণে পরিবারের সবার সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মো. ফুরকান কচু ক্ষেতের একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। তিনি বলেন, বেতনের সঙ্গে খরচের হিসাব মিলছে না। যে হারে বেতন বাড়ছে তার চেয়ে দ্বিগুণ খরচ বাড়ছে। এতে জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজে এখন একটি মেসে থেকে চাকরি করেন।
এদিকে গত বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সরকারি ক্রয় কমিটির বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারে আলুর দাম বাড়লেও, অন্য জিনিস সাশ্রয়ী হয়েছে। দাম বাড়ার বিষয়টি সবাই বলে, কিন্তু দাম কমারটা বলে না। বাজারে প্রত্যেকটার দাম কমানো সম্ভব না। বাজার এমন একটা জিনিস একটার দাম কমবে, একটার দাম বাড়বে। সরকার তাড়াতাড়ি প্রসেস করে, যৌক্তিক যে জিনিসগুলো ক্রয় করা প্রয়োজন সেগুলো অনুমোদন দিচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, ইচ্ছাকৃত সংকট তৈরি করে ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা প্রথমে সংকট তৈরি করলো। এরপর বাণিজ্য উপদেষ্টার উপস্থিতিতে দাম বাড়ানো হলো। স্বাভাবিক হলো বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজার। ক্রেতাদের জিম্মি করে এ ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি বলে দেয় বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন দরের পাশাপাশি মিলছে পুরনো দামের তেলও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেট যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। ডিলারদের দাবি, দাম বাড়ার পর বাড়ছে সরবরাহ।
সরকার যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তার প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাব যে একেবারে নাই তা নয়। আপনারা খালি দেখেন আলুর দাম বেড়ে গেছে, অন্যগুলোতো সাশ্রয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের প্রভাব পড়ছে এখন। তবে, সব পণ্যের দাম একসঙ্গে কমানো সম্ভব নয়।
গত মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো সরবরাহ ও ঘাটতির বিপরীতে যে জোগান দরকার, সেটা ঠিক রাখা। যে কারণে সম্প্র্রতি আমরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছি। তবে সেটা সাধারণ ক্রেতার জন্য কষ্টসাধ্য হলেও বাস্তবতার জন্য দরকার ছিল। এটা না করলে বাজারে ব্যাপক সংকট তৈরি হতো, ঘাটতি বেড়ে যেতো। এখন আমরা অন্য কোনো পণ্যের দাম কমিয়ে সেটা সমন্বয়ের চিন্তা করছি। শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, এখনো বাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে কথা হচ্ছে। তেল-চিনির সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তারা বাজারের একটা বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। পালিয়ে যাওয়ার কারণে সরবরাহে ঘাটতি হয়েছে।
বাজারে পণ্যের ঘাটতি পুরনো সরকার আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কমানো হয়েছিল শুল্ক ও কর। তবে আমদানি খুব একটা বাড়েনি। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেয়া ও শুল্ককর কমানোর কারণে বাজার স্থিতিশীল আছে। নতুন করে কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে না। তবে দাম কমছে না কেন এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারও কাছ থেকে। সরকার শুল্ককর তুলে নিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন চাল।
সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ই অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯শে নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে ৫ শতাংশে। তাতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর ১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। কিন্তু দাম কমেনি। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী গত এক মাসে এক লাখ টন ভোজ্য তেল এসেছে। সাধারণত দেশে মাসে দুই লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। একইভাবে আলু, পিয়াজের আমদানি শুল্ক কমালেও দাম কমেনি।
এসএস//