ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ১১ ১৪৩১

১২ মাসে ৮ বোনাস শিক্ষা বোর্ডে!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৩১ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার

দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার নির্ধারিত বেতন-বোনাসের বাইরে ইচ্ছামতো ভাতা ও সম্মানি নিচ্ছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে বেতনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের দেওয়া পরীক্ষার উচ্চ ফি থেকে তারা এই বাড়তি আয় করছেন। ১২ মাসে নিচ্ছেন আটটি বোনাস।

সূত্র মতে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই ঈদে সরকার নির্ধারিত মূল বেতনের সমান দুটি উৎসব ভাতা এবং মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরা নিয়ম করে মূল বেতনের সমপরিমাণ আরো পাঁচটি উৎসব ভাতা নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১২ মাসে আটটি বোনাস নেন। বোর্ডগুলোতে প্রায় প্রতিদিন কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠক থাকে। অফিসের নির্ধারিত সময়ে সেসব বৈঠক হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা আলাদা সম্মানি নিয়ে থাকেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বছরে আটটি বোনাস ও নানা ধরনের সম্মানি নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ তারা বিভিন্ন পরীক্ষার ফি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করছেন। এত টাকা তাদের ব্যয় করারও সুযোগ নেই। তারা নিজেরাই নিয়ম করে দীর্ঘদিন ধরে এই বোনাস নিয়ে যাচ্ছেন। আর এই টাকায় বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিলাসী জীবন যাপন করছেন।

এদিকে দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি মিলে বোর্ডের সংখ্যা ১১। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঢাকা বোর্ড। তাদের আয় অন্য তিন-চারটি বোর্ডের সমান। সারা দেশের মাদরাসাগুলোর জন্য একটি বোর্ড হওয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে এই বোর্ড।

জানা যায়, শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধনী ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তাদের খরচ ও ভাতা-সম্মানিও বেশি। ইচ্ছামতো খরচের পরও তাদের কয়েক শ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। এর পরও প্রায় প্রতিবছরই বাড়ানো হচ্ছে পরীক্ষার ফি।

সূত্র জানায়, সরকার নির্ধারিত দুই ঈদে দুই উৎসব বোনাস ও বৈশাখী ভাতার পাশাপাশি বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূল বেতনের সমান বর্তমানে আরো পাঁচটি ভাতা পেয়ে থাকেন। এসএসসির রেজিস্ট্রেশনের সময় পান মূল বেতনের অর্ধেক বোনাস, পরীক্ষা শুরুর সময় অর্ধেক, পরীক্ষা শেষে একটি পূর্ণ বোনাস এবং ফল প্রকাশিত হলে আবার অর্ধেক বোনাস পেয়ে থাকেন। একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও তারা বোনাস পেয়ে থাকেন। এতে অতিরিক্ত পাঁচটি বোনাস নেন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর বাইরে বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রতিটি সনদে স্বাক্ষরের জন্য এক টাকা করে পেয়ে থাকেন।

সূত্রটি আরও জানায়, শিক্ষা বোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাদের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি উচ্চ পদগুলোতে সাধারণত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রেষণে পদায়ন পেয়ে থাকেন। বোর্ডের আইনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা করে বিভিন্ন ভাতা বা সনদ ও নম্বরপত্রে স্বাক্ষরের জন্য টাকা নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু বোর্ড সভা ও অর্থ কমিটিতে নিজেরাই এসব ভাতা ও স্বাক্ষরের জন্য টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে নিয়েছেন। পরে তা মন্ত্রণালয় থেকেও অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক বেশি কাজ করতে হয় বলে এ ধরনের ভাতার উদ্যোগ। তবে চেয়ারম্যানরা যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসেন, তাই তাদের পক্ষে আগে থেকে চালু থাকা কোনো নিয়মে হাত দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিলে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ বাবদ বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থীদের (নিয়মিত) জন্য নেওয়া হয় দুই হাজার ২৪০ টাকা। ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের পরীক্ষার্থীদের (নিয়মিত) জন্য নেওয়া হয় দুই হাজার ১২০ টাকা। ফলে শুধু এসএসসি পরীক্ষার ফি থেকে ১১ শিক্ষা বোর্ডের আয় হয়েছে ৪২৯ কোটি টাকা। এখান থেকে কেন্দ্র ফি বাবদ শিক্ষার্থীপ্রতি ৪৫০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। ফরম পূরণ বাবদ বিজ্ঞান শাখার পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোট দুই হাজার ৬৮০ টাকা এবং মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই হাজার ১২০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে পরীক্ষার ফি বাবদ বোর্ডের আয় হয়েছে প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা। এই টাকা থেকেও এসএসসির মতো ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা জমা রয়েছে। দুই পরীক্ষার ফি হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৩৬ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, যে বোর্ডে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যত বেশি, তাদের আয়ও তত বেশি। আর নিজস্ব আয় থাকায় তারা ইচ্ছামতো খরচও করতে পারেন। প্রতিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান অর্থ ব্যয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, আমরা খাতভিত্তিক হিসাব করে পরীক্ষার ফি নিয়ে থাকি। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করা পর্যন্ত নানা খাতে ব্যয়। ফলে এই ফির বেশির ভাগ খরচ হয়ে যায়। তবে অনেক সময় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোর্ডের ফির সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ করে শিক্ষার্থীদের ফি নির্ধারণ করে, যা মোটেই ঠিক নয়। বোর্ডের নির্ধারিত পরীক্ষা ফি কিছুটা কমানো যায় কি না, সে ব্যাপারে আমরা আন্ত শিক্ষা বোর্ডে ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করব।

এসএস//