খিদের জ্বালায় দেহব্যবসায় নামছেন তরুণীরা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:৪৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ শনিবার
একদিকে গৃহযুদ্ধ, অন্যদিকে ভেঙে পড়া অর্থনীতি। জোড়া ফলার আক্রমণে দুইবেলা খাবার জোগাতে মানুষের জীবন দফারফা। পেটের জ্বালায় অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বেআইনি পথ। বাদ নেই মহিলা চিকিৎসক ও নার্সেরা। সংসারের খরচ সামলাতে দেহব্যবসায় নেমেছেন তাদের একাংশ। প্রতিবেশী মিয়ানমারের এমন সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা চিন্তায় দেশটির কর্তাব্যক্তিরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত আমেরিকার সংবাদ সংস্থা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত তিন-চার বছরে মায়ানমারে যৌনকর্মীর সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশি আয়ের আশায় এই পথে নামছেন মহিলা চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে শিক্ষিকারা। অধিকাংশই এ কাজ করছেন পেটের জ্বালায়। তবে এ ব্যাপারে কোনও মাথাব্যথা নেই দেশটির সামরিক জুন্টা সরকারের।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মায়ানমারের ক্ষমতা দখল করে জুন্টা। ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড অতিমারির ধাক্কা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। ওই সময়ে এমনিতেই দেশের আর্থিক অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তার মধ্যে জুন্টা কুর্সিতে বসায় সাবেক বর্মায় বেধে যায় গৃহযুদ্ধ।
ঘরোয়া কোন্দল আর কোভিডের আক্রমনে গত তিন বছরে হু-হু করে নেমেছে অর্থনীতির সূচক। মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে ২৬ শতাংশে। ফলে বাজারে আগুন দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আগামী বছর ২০২৫ সালে মায়ানমারের আর্থিক বৃদ্ধির সূচকের আরও পতন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
দেশটির এই দুর্বিষহ অবস্থার কথা নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে তুলে ধরেছেন সদ্য চিকিৎসার ডিগ্রি পাওয়া বছর ২৬-এর বর্মীয় তরুণী মে। তিনি বলেন, ৪১৫ ডলার হাতে থাকলে মুহূর্তে তা উবে যায়। ওই টাকায় আজকাল আর জলও গরম করা যায় না। পরিবারের নিত্যদিনের খরচ চালানোই দায়! আমাদের কাছে রোজগারের একমাত্র পথ হলো দেহব্যবসা।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল মান্দালয়ে। যৌনকর্মীর সংখ্যা সেখানে উত্তরোত্তর বাড়ছে বলে খবর মিলেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে মে আরও বলেন, আমাদের এখানে দেহব্যবসা আইনত সিদ্ধ নয়। শহরাঞ্চলে, বিশেষত যেখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে, সেখানে ‘ডেট গার্ল’দের দেখা মিলবে। এরা প্রত্যেকেই যৌনকর্মী। পেটের জ্বালায় ডেটিংয়ের নামে এই পেশায় নেমেছেন তারা।
মিয়ানমারে গত তিন বছরে ঠিক কত জন যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিয়েছেন, সেই সংখ্যা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, তথাকথিত ভাল চাকরি বা কাজ ছেড়ে এতে নাম লেখাচ্ছেন তরুণীদের একাংশ। অনেকে আবার উপরি রোজগারের জন্য যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিয়েছেন। শিক্ষিত মেয়েদের এ দিকে ঝোঁক বেশি বলে জানা গিয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সেনা অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে মেয়েরাই প্রথম রাস্তায় নেমেছিলেন। জুন্টার সৈনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় উড়িয়ে বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন তারা। এতে মিয়ানমারের পিতৃতান্ত্রিক অচলায়তন ভেঙে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে ক্ষমতার একেবারে শিকড়ে পৌঁছে যায় সেনা।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জুন্টা সরকার। সেগুলির দখল নিয়েছে বিদ্রোহীরা। তবে দেশের মূল শহরগুলির জুন্টার দখলেই রয়েছে। আর সেখানে দিন দিন বাড়ছে যৌনপল্লীর সংখ্যা। কারাওকে পানশালা, নাইটক্লাব এবং হোটেলে চুটিয়ে চলছে এই দেহব্যবসা।
এই ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে আরও খোলামেলা ভাবে কথা বলেছেন বছর ২৫-এর জার নামের এক তরুণী। তিনি বলেন, এতে এক রাতে ৮০ ডলার পর্যন্ত উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। মাসের হিসাবে টাকাটা অনেকটাই বেশি। আমাদের খদ্দেরদের অধিকাংশই চিনা নাগরিক। ভাঙা ইংরেজি এবং বর্মিজ় ভাষায় কথা বলতে পারেন তাঁরা। অবশ্যই কাজটা ভাল নয়। প্রথম প্রথম এর জন্য লজ্জাও পেতাম। তবে এখন টাকাটা প্রয়োজন।
মান্দালয়ের একটি সেনা হাসপাতালে নার্স ছিলেন জার। ধনী খদ্দেরের হদিস পেতে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই পেশায় পদে পদে রয়েছে পুলিশের হাতে ধরা পরার ভয়। জার জানান, ধরা পড়লে ঘুষ দিয়ে শাস্তি এড়ান তারা।
এদিকে দেশটির এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সেনা বা পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবারের। সেনা অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে বহু নিরীহ মিয়ানমারবাসীর। তাদের স্ত্রী বা মেয়েদের ঘরের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তার পরও দুইবেলা পেট ভরে খাবার জুটছে না তাদের। ফলে যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
সূত্র: আনন্দবাজার
এসএস//