ঢাকা, সোমবার   ১৩ জানুয়ারি ২০২৫,   পৌষ ৩০ ১৪৩১

দেশের ক্রান্তিকালে অর্থনীতির শেষ আশ্রয়স্থলকে কখনো অবহেলা করা যাবে না

জাহিদ আল আসাদ

প্রকাশিত : ০৮:২৭ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ সোমবার | আপডেট: ০৮:৪২ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ সোমবার

দেশের অর্থনীতি কেমন আছে, এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলতে পারি- অর্থনীতি চাপে আছে। বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জমজমাট আড্ডা। সাথে দেশে ডলারের রিজার্ভ নিম্নমুখে হাঁটা ধরেছিল এতো দিন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত পাঁচ মাসে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস গার্মেন্টস শিল্পে বিরাজ করছিল নানা অস্থিরতা। একই সাথে প্রয়োজনীয় আমদানি করতে খরচ করতে হচ্ছিল রিজার্ভে মজুদ থাকা ডলার। আবার পূর্ববর্তী সময়ের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপতো আছেই।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যে, অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে কোন জিনিসটা এতো অস্থিরতার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতিকে আগলে রেখেছে। খাদে পড়তে দিচ্ছেনা, বটবৃক্ষের মতো গভীর শিকড় দিয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছে আমাদের অর্থনীতিকে। 

যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার মজুদের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিল না, চারদিকে বলা হচ্ছিল ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলারের মজুদ না থাকলে কার্যত শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটবে দেশ। তখন দেশের অর্থনীতির জন্য শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বরাবরের মতো ভরসা হয়ে দাঁড়ালো রেমিটেন্স। দেড় কোটির অধিক প্রবাসী তাদের সবটুকু দিয়ে দেশের এই কঠিন সময়ে অর্থনীতির লাইফ লাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

যেখানে আইএমএফ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে কত শত শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে আমাদের দেশকে। সেখানে আমাদের প্রবাসীরা প্রতি মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার করে দেশে পাঠাচ্ছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঊর্ধ্বমুখী রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর ভর করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে আমাদের অর্থনীতি রক্ষা পেয়েছে।

জানা যাচ্ছে, চলতি অর্থ বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১১.১৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এই পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ এই ৫ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.১ বিলিয়ন  ডলার। এছাড়া এই রেমিট্যান্সের উপর ভর করেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সূচক চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের ঘাটতি কমেছে ৯৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব বলছে, বর্তমানে  দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি ২২৬ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩.৯৪ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের ৩১ জুলাই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৮ ডিসেম্বরের হিসেব অনুসারে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২৬ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ’র বিপিএম-৬ গণনার মান অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২১ দশ‌মিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

সর্বশেষ হিসেব অনুসারে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি থাকায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য তথা ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ঘাটতি পূর্বের অর্থবছরে তুলনায় প্রায় ৪৯.৫ শতাংশ কমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি-রপ্তানির সার্বিক ঘাটতি বা বিওপি কমে দাঁড়িয়েছে ২.৪৭ বিলিয়ন ডলারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন 'এই ইতিবাচক অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। কারণ, এই সময়ে তেমন কোনো  বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান পাওয়া যায়নি। বৈদেশিক ঋণে কম প্রবৃদ্ধি থাকার পরও ঘাটতি কমেছে যা অর্থনীতির জন্য একটা ভালো বলে মন্তব্য করেন অনেক বিশ্লেষক।  

এছাড়া, সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি ২০ শতাংশ কমেছে বলে বিভিন্ন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭.৮৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯.৮৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া এই পাঁচ মাসে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.১ শতাংশ, আর আমদানি কমেছে ১.২ শতাংশ।

আমদানি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয় প্রায় ১.৬৬ বিলিয়ন বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি কমানো গেছে।

যাদের পাঠানো টাকা আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন, তাদেরকে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কতখানি সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারছি? বিমানবন্দরে অন্তত প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারছি না কেন? সচেতন নাগরিক হিসেবে সবার মনেই এই আক্ষেপ কাজ করে।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট। 

এএইচ