রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোট চায় ৮৩ শতাংশ মানুষ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:০৫ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ শনিবার
রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোট চায় ৮৩ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে এমন মতামত এলেও সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নেই সরাসরি ভোটের বিধান।ফলে ইসি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ তৈরির জন্য বিবিএস ওই জরিপ চালালেও সুপারিশে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি।
সম্প্রতি বিবিএস পরিচালিত একটি জরিপের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য ইসি সংস্কার কমিশন বলছে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতে রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোট হলে সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন চলে আসবে। যে কারণে তাদের সুপারিশে জরিপের ফলাফলের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ ছিল না।
ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তার সুপারিশ তৈরির জন্য জনমত জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। সংস্কার কমিশনের অনুরোধে জরিপ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএস ‘বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতে’ গত ২০-২২ ডিসেম্বর মাঠপর্যায়ে জরিপ চালায়। জরিপটির গ্রহণযোগ্যতার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংসদ সচিবালয়, অর্থ বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বিবিএসের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি, একটি টেকনিক্যাল কমিটি ও একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়।
জরিপের জন্য সারাদেশে ৪৬ হাজার ৮০টি খানা থেকে একজন করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খানা, হোস্টেল, হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, সামরিক ও পুলিশ ব্যারাক, কারাগার ইত্যাদিকে জরিপের বাইরে রেখে শুধু সাধারণ খানা থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। ভোটার হওয়ার যোগ্য অর্থাৎ ১৮ তদূর্ধ্ব নাগরিকের মধ্য থেকে প্রতিটি খানা থেকে নির্বাচিত যোগ্য একজন উত্তরদাতা হতে নির্ধারিত প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।
২৫ ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে বিবিএসের জরিপের ২৪টির ফলাফলের প্রতিফলন ইসি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উঠে এসেছে। ব্যতিক্রম ছিল কেবল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে।
জরিপের ফলাফল পর্যালেচনা করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জনগণের সরাসরি ভোটের পক্ষে মত দিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচনের কথা বলেছেন মাত্র ১৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। পুরুষের চেয়ে নারীরা তুলনামূলকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোটের পক্ষে মত দিয়েছেন। গ্রহণকারীদের মধ্যে ৮১ দশমিক ৫১ পুরুষ ও ৮৩ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোটের কথা বলেছেন।
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ সংসদের দুটি কক্ষের (যদি কার্যকর হয়) দুই-তৃতীংশ সদস্যের গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এ প্রশ্নে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ‘জানি না’ জবাব দিয়েছেন। শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ জবাব দিতে অনিচ্ছার কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভাগ, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশার ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সরাসরি ভোটের পক্ষে সর্বনিম্ন ৬৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি শ্রমিক শ্রেণি ৮৫ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং সব থেকে কম সরকারি চাকরিজীবী শ্রেণি ৬৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রত্যক্ষ ভোটের কথা বলেছেন।
সরাসরি নির্বাচন প্রশ্নে মাস্টার্স ও তদূর্ধ্ব পাস নাগরিকরা তুলনামূলক কমসংখ্যক মত দিয়েছেন। যেখানে সরাসরি ভোটে জাতীয় গড় ৮২ দশমিক ৬৫ শতাংশ সেখানে এই উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মত ৬৮ দশমিক ০৬ শতাংশ। এদিকে রাষ্ট্রপতিকে নির্দলীয় ব্যক্তি হওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৬৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। দলীয় ব্যক্তি হওয়ার কথা বলেছেন ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে গ্রামের চেয়ে শহরের জনগণ নির্দলীয় হওয়ার পক্ষে বেশি মত দিয়েছেন। শহরের ৭৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও গ্রামের ৬৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
জরিপের ফলাফলের প্রতিফলনস্বরূপ ইসি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিলে নির্বাচন পদ্ধতি প্রশ্নে আসছে উল্টো সুপারিশ। এক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ মতামতকারী যে পরোক্ষ নির্বাচনের কথা বলেছেন সুপারিশে তার প্রতিফলন ঘটেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি স্বীকার করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা হয়তো এ প্রশ্নের বিষয়টি বুঝতে পারেনি, যার কারণে তারা প্রত্যক্ষ ভোটের পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচন করা হলে সরকার ব্যবস্থাই পরিবর্তন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে যুক্তি তুলে ধরে বদিউল আলম বলেন, সরাসরি নির্বাচন হলে রাষ্ট্রপতি সারাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী একটি নির্বাচনি এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন। এক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রশ্নে একধরনের দ্বন্দ্বের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব হতে পারে। এ বিবেচনায় আমরা পরোক্ষ ভোটের সুপারিশ করেছি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী বলেন, তাদের সঙ্গে অংশীজনসহ বিভিন্ন ধরনের মতামতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ভোটের সুপারিশ এসেছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে তারা প্রত্যক্ষ ভোটের সুপারিশই করেছেন। এদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে বিবিএসের জরিপে নির্বাচনে ৪৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ মতামতকারী ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা ও ৪৪ দশমিক ০৪ শতাংশ জেলা প্রশাসকের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের পক্ষে মত দিয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনি এলাকার দলের প্রাথমিক সদস্যদের তৈরি প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়নে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়ার পক্ষে ৭২ দশমিক ৬৯ শতাংশ মত দিয়েছেন। নির্বাচনে ‘না’ ভোট জয়ী হলে ৭৮ দশমিক ২৫ শতাংশ মতামতকারী নতুন তফসিল দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ নতুন তফসিল দিয়ে নির্বাচনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনের মোট ভোটের ৫০ শতাংশের কম হলে সেখানে পুনির্বাচনের কথা বলেছেন ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সংসদ নির্বাচনে নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করে সরাসরি ভোটের পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ না হলে রাজনীতি জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তির ব্যবসায়িক সার্থে পরিচালিত হওয়ার বিদ্যমান সংস্কৃতি অব্যাহত থাকা এবং স্বৈরাচারী ব্যবস্থা ফিরে আসার আশঙ্কার পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এসএস//