ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫,   ফাল্গুন ১৪ ১৪৩১

মানুষের ক্ষমতা প্রাপ্তি এবং অল্প পানির মাছ তত্ত্ব

জাহিদ আল আসাদ

প্রকাশিত : ০৭:০২ পিএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বুধবার

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ' তার একটি তুলসী গাছের কাহিনী গল্পে লিখেছিলেন, “হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে”। তেমনই মানুষ অনেক সময় ঘটনা চক্রে কিংবা হঠাৎ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। এই ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব মানুষের আচরণে এক পরিবর্তন সাধন করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই পরিবর্তনকে আচরণগত বৈকল্য বলে। জন ফ্রেঞ্চ এর ক্ষমতার ভিত্তি তত্ত্ব অনুসারে মানুষ নানা ভাবে ক্ষমতা বা কতৃত্ব লাভ করতে পারে। যেমনঃ আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার উৎস রেফারেল পাওয়ার আর শাসকের কেতাবি ক্ষমতার উৎস জনগণ হলেও ক্ষমতা প্রযুক্ত হয় Coercive Power এর মাধ্যমে। 

মানুষের ক্ষমতা প্রাপ্তির এই ঘটনা কে আমরা একটা রূপক ঘটনার সাথে তুলনা করতে পারি। আমার উচ্চ বিদ্যালয় জীবনের শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষকের কথার মাঝে এই রূপক তত্ত্বের সুত্র খুঁজে পেয়েছিলাম। আমদের মানব জীবনে সাধারণত অন্যের উপর কতৃত্বহীন অবস্থা বিরাজ করে। এটাই আমাদের জীবনের পরম অবস্থা। এই অবস্থাকে আমরা “ডাঙায় থাকা মাছের সাথে” তুলনা করতে পারি। সহজ কথায়, মানুষের ক্ষমতা ও কতৃত্ব বিহীন অবস্থা হচ্ছে ডাঙায় তোলা মাছের মতো। আর ক্ষমতা পাওয়ার মানে হচ্ছে সেই মাছকে অল্প পরিমান পানিতে নামিয়ে দেয়ার মতো। সেই অল্প পানি পেয়ে মাছটা যেমন লাফালাফি করে তেমনি মানুষ মহান স্রষ্টা আল্লাহর আশীর্বাদে কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতা পেয়ে ঐ অল্প পানির মাছের ন্যায় আচরণ করে। সেই মানুষ নিজের মানবীয় পরম সত্ত্বাকে ভুলে যায়। 

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের “ID” সত্ত্বা তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে আর তার “সুপার ইগো” সত্ত্বা দুর্বল হতে থাকে। ফলে সে ক্ষমতার চর্চা করার মাধ্যমে মানুষকে বিড়ম্বিত করে আনন্দ লাভ করে। অথচ তার ক্ষমতা লাভের আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কল্যান ও উপকার করা।  

যুক্তরাষ্ট্রের National Library of Medicine এর On power and its corrupting effects: the effects of power on human behavior and the limits of accountability systems -শীর্ষক এক গবেষণায় মত দেয়া হয় যে, “ ক্ষমতাশালী মানুষ অন্যদের ওপর কঠোর নৈতিক মানদণ্ড প্রয়োগ করতে খুব সচেষ্ট থাকলেও তারা নিজেদের বেলায় তার উল্টো মনোভব পোষন করে। 

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টন মনে করতেন, ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপ্রবণ করে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা তাকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে।’ আসলে প্রকৃত অর্থে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। চূড়ান্ত ক্ষমতা মানুষের জন্য বেশিরভাগ সময় চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে আনে। হিটলার কিংবা মুসোলিনিরা চুড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করে ফলাফলে ধ্বংস হয়েছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা পেয়ে তার অপব্যবহারের ফলাফলে হাতে পেয়েছেন গ্যালোটীনের ফরমান কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। 

আসলে ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। তবে ক্ষমতার বিনাস নেই। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহারকারীর বিনাস আছে। ক্ষমতার হাত বদল হয়। যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পায় সে বেশিরভাগ সময় ক্ষমতার হাত বদলের কথা বেমালুম ভুলে যায়। সমাজিক মনোবিজ্ঞান বলছে, ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষ তার অপব্যবহারটাই বেশি করে। তার ফলে ব্যক্তি হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। ক্রমেই সে অসাধু ও কুচক্রী হয়ে ওঠে। ফলে তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। 

অর্ধ শতাব্দি আগে মানুষের ক্ষমতা লাভের সাথে আচরণ সংক্রান্ত এক গবেষণা হয়েছিল ‘স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট নামে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক ফিলিপ জিমবার্ডোর নেতৃত্বে এ গবেষণাটি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে । এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা মানুষের মনে কী প্রভাব ফেলে তা জানা। এর ফলাফলে বলা হয়, খুব সাধারণ মানুষও ক্ষমতা লাভের ফলে চরম কর্তৃত্ববাদী আচরণ প্রদর্শন করতে পারে।

গবেষণায় কিছু ছাত্রকে কাল্পনিক কারাবন্দি ও কারারক্ষী হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্য নেয়া হয়। পরীক্ষার পর দেখা গেল, কারারক্ষীর চরিত্রে অভিনয় করা ছাত্ররা কারবন্দি হিসেবে অভিনয় করা ছাত্রদের ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু করছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, কোনো কোনো কারাবন্দি এই মানসিক নির্যাতনে প্রায় অসুস্থও হয়ে পড়লেন। আরও বিস্ময়কর, কারারক্ষীদের চাপে তারা অন্য কারাবন্দি ছাত্রদের মানসিক নির্যাতন করা শুরু করলেন। পরিস্থিতি এমন হলো, দুদিন যেতে না যেতেই দুই ছাত্র পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি চাইলেন। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীদের ওপর কারাবন্দিদের মানসিক নির্যাতনের মাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, ওই পরীক্ষা ছয় দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! 

মানুষের ক্ষমতা নিয়ে পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানহু তা’আলা নির্দেশ করেছেন। সূরা আল ইমরানের ২৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমান কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। ’

মানুষ ক্ষমতা লাভের সাথে সাথে দাম্ভিক ও অহংকারী হয়ে ওঠে। রাসুল (সা.) দাম্ভিকতা নিয়ে সতর্ক করেছেন। সুনানে তিরমিজির হাদিসে এসেছে, “দাম্ভিক ব্যক্তিদের কিয়ামতের দিন ক্ষুদ্র পিঁপড়ার মতো মানুষের রূপে সমবেত করা হবে। তাদের চারদিক থেকে অপমান ও লাঞ্ছনা ছেয়ে ফেলবে। জাহান্নামের বুলাস নামক একটি কারাগারের দিকে তাদের টেনে নেওয়া হবে। আগুন তাদের গ্রাস করবে, জাহান্নামিদের গলিত রক্ত ও পুঁজ তাদের পান করানো হবে।” 

অথচ মানুষ কিছু সময়ের ফলে যেকোনো ভাবে ক্ষমতা লাভ করে ধরা কে সরা জ্ঞান করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়ঃ উগান্ডার একজন আমলা হয়তো এতোদিন একটা কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম ক্ষমতাশালী চেয়ারে ছিলেন। তিনি ঠিকই এতোদিন নিজের বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখে চলতেন। কুশলাদি অন্তত বিনিময় করতেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ করে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী মন্ত্রণায়য়ের কর্তার চেয়ারে বসলেন। তখন সেই তিনিই আর কাউকে যেন চিনেও চিনেন না। মানুষ বা সেবাপ্রত্যাশীর সাথে নিদেন পক্ষে কিছুটা ক্ষমতা দেখাতে পারলে যেন তিনি মানসিক ভাবে চাঙ্গা বোধ করেন। ধারণা করা হয় অন্তত ৯৫ শতাংশ মানুষের আচরণে এরকম প্রভাব দেখা যায়। এবার উদাহরণ হিসেবে উগান্ডার একজন শিক্ষকের কথা ধরা যাক। এতোদিন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করলেও তাকে জনবিচ্ছিন্ন হতে দেখা যায় নি। অথচ তিনি যখনই কোনো প্রশাসনিক পদ, যেমন ভিসি বা প্রো-ভিসি হলেন, তখনই তার আচরণের দৃশ্যনীয় পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। তবে কিছু মানুষ আছেন যারা ক্ষমতা লাভ করলেও দাম্ভিকতা ও দুর্নীতি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। তারাই প্রকৃত মানুষ, তারাই মানব জাতির জন্য কল্যান বয়ে আনবেন। 

লেখক: কলামিস্ট, বিশ্লেষক ও শিক্ষক।

 

এমবি//