ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৪ মার্চ ২০২৫,   ফাল্গুন ১৯ ১৪৩১

হাসিনার আমলে ফেসবুকে ‘কবিতা’ লেখায় বরখাস্তসহ ছয়টি শাস্তি পান ট্রেন চালক

বদরুল হাসান লিটন, রাজশাহী থেকে

প্রকাশিত : ১০:১৪ এএম, ৩ মার্চ ২০২৫ সোমবার | আপডেট: ১০:১৫ এএম, ৩ মার্চ ২০২৫ সোমবার

'অসৎ অফিসার' নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কবিতা লেখার পর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে রেল কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্তসহ ছয়টি শাস্তি দেয়।

তবে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলার পর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এক বছর ছয় মাস পর আদালত তাকে মুক্তি দেন। গত ২৮ জানুয়ারি আবুল কালাম আজাদ রায়ের কপি হাতে পান এবং পরে তিনি ঈশ্বরদী লোকোশেডে তা জমা দেন।

আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে ৩০ লিটার তেল চুরির অভিযোগ তোলা হয় ২০২২ সালের ৩ আগস্ট। ওই ঘটনায় পরের দিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে ৪ ডিসেম্বর তাকে ছয়টি শাস্তি দেওয়া হয়। 

শাস্তিগুলো হলো- চালক থেকে সহকারী চালক পদে নামিয়ে দেওয়া, ১২১ দিন সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা, এই সময়ে সকাল-বিকেল দুইবার পাকশীতে বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলীর (ডিএমই) দপ্তরে হাজিরা দেওয়া, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি চার বছরের জন্য স্থগিত করা, ১৩তম গ্রেড থেকে ১৬তম গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া এবং খুলনা লোকোশেড থেকে পার্বতীপুর লোকোশেডে বদলি করা।

আবুল কালাম আজাদ রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে যে কথিত অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটি ছিল ২০২২ সালের ৩ আগস্টের ঘটনা। ওই সময় তিনি খুলনা লোকোশেডে কর্মরত ছিলেন।

সেদিন তিনি যে ট্রেনটি চালিয়েছিলেন সেটি ছিল তেলবাহী। যশোরের চেঙ্গুটিয়া স্টেশন পার হওয়ার সময় ইঞ্জিন থেকে সাদা বস্তাসদৃশ বস্তু চলন্ত ট্রেন থেকে পড়তে দেখেন বলে ট্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য গৌতম কুমার ও কর্মরত গার্ড বিশ্বজিৎ কুমার অভিযোগ করেন। ওই বস্তাসদৃশ বস্তুতে করে তেল চুরি করা হয়েছে- এই অভিযোগেই আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং পরে একসঙ্গে ছয়টি শাস্তি প্রদান করা হয়।

অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন পার্বতীপুর লোকোশেডের ফুয়েল ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা। বর্তমানে তিনি পাকশীতে সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলী পদে কর্মরত রয়েছেন। তদন্ত কমিটির আরও দুজন সদস্য ছিলেন। তারা ২০২২ সালের ৮ আগস্ট বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (ডিএমই) আশীষ কুমার মণ্ডলের দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে দেখানো হয়, ওই দিন চালক আবুল কালাম আজাদের লোকোমোটিভে (ইঞ্জিনে) ৩০ লিটার তেল ঘাটতি পাওয়া যায়।

শাস্তির কারণে আবুল কালাম আজাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। চিকিৎসার অভাবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তার মা মারা যান। তখন তার মেয়ে খুলনা নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত।

অর্থাভাবে মেয়েকে ওই বিদ্যালয়ে পড়াতে না পেরে পরে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। তার ছেলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর সামর্থ্য না থাকায় পরে তাকে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেন।

তবে আবুল কালাম আজাদ হাল ছাড়েননি। তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাই ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন (মামলা নম্বর ৬৭/২০২৩)। এক বছর পর, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, তিনি তেল চুরি করেননি, বরং রেলওয়ের তেল সঞ্চয় করেছেন। তাকে পুরস্কার দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো সাজানো অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

আদালত তার শাস্তি প্রত্যাহার করে প্রতিকারের নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনালে মামলার পর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বরং রায়ে বলা হয়, আবুল কালাম আজাদ ওই দিন রেলের ১৬ লিটার তেল সঞ্চয় করেছেন। শুধু তা-ই নয়, ওই আগস্ট মাসে তিনি মোট ৩০ লিটার তেল সঞ্চয় করেছেন।

এ ছাড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বস্তাসহ তেল ফেলে দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়নি। আদালত তার শাস্তিকে 'সাম্যতাহীন দণ্ড' এবং অভিযোগের তুলনায় প্রদত্ত শাস্তিকে 'আধিক্যের দোষে দুষ্ট' বলে উল্লেখ করেন।

খুলনা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য (জ্যেষ্ঠ জেলা জজ) মো. আব্দুল মান্নান ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই এই রায় দেন। রায়ে আরও বলা হয়, রেলওয়ের কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক। শাস্তি প্রদানের আগে অবশ্যই তাকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা উচিত ছিল।

আদালত আরও উল্লেখ করেন, প্রকৃতপক্ষে তা না করায় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রায়ে বলা হয়, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে আবেদনকারীকে যে চূড়ান্ত আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা বেআইনি মর্মে বাতিল করা হলো। আদালত নির্দেশ দেন, তিনি এখনো চাকরিতে স্ব-স্কেলে বহাল আছেন গণ্য করে বকেয়া বেতন ভাতাদি, জ্যেষ্ঠতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রায়ের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা ছিলেন ট্রেনের শেষ বগির গার্ড ব্রেকে (গার্ডদের বিশ্রামের বগি)। ট্রেনটি ছিল তেলবাহী এবং এতে ২৯টি বগি ছিল। এই ২৯ বগির শেষ মাথা থেকে সামনের ইঞ্জিন পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব। ফলে সেখান থেকে কিছুতেই সামনের ইঞ্জিন থেকে কিছু পড়ার দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়।

এ ছাড়া ওই দিনের গার্ড রিপোর্টেও অভিযোগকারী গার্ড বিশ্বজিৎ কুমার ইঞ্জিন থেকে বস্তা পড়তে দেখার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেননি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে গার্ড রিপোর্টে তা উল্লেখ করার কথা।

আবুল কালাম আজাদ জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন সংকেত খাতা অনুযায়ী অভিযোগে উল্লেখিত সময়ের আধা ঘণ্টা আগেই ট্রেনটি ওই স্টেশন ছেড়ে আসে। বাস্তবে চেঙ্গুটিয়া একটি বন্ধ স্টেশন, যেখানে কোনো ট্রেন দাঁড়ায় না। অভিযোগে বলা হয়েছিল, ননভ্যাকুয়াম ট্রেন বলে এটি চেঙ্গুটিয়া স্টেশনে থামানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে কৃষক মো. মুছা নামের এক সাক্ষী বলেছেন, ট্রেন থামিয়ে বস্তা নামানো হয়েছে।

আবুল কালাম আজাদ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছেন, কিন্তু কেউ তার কথা শোনেননি। তিনি বলেন, তিনি একজন কবি এবং তার দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

ফেসবুকে 'অসৎ অফিসার' নামে কবিতা লেখার চার-পাঁচ মাস পরেই তার বিরুদ্ধে 'ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ' আনা হয়। তিনি বলেন, একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যই মামলা করেছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো কর্মচারী এ ধরনের নিপীড়নের শিকার না হন।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পাকশী বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (ডিএমই) আশীষ কুমার মণ্ডল বলেন, তিনি এখনো রায়ের কপি হাতে পাননি। ঈশ্বরদী লোকোশেডে জমা দিলে পরে তিনি তা পাবেন। আদালতের রায়ে নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যে কবিতার পর আবুল কালাম আজাদের জীবনে এত ঝড় বয়ে গেল, তার কয়েকটি লাইন হচ্ছে:

অসৎ অফিসার যারা
ঘুষ খায় তারা।
চাকরির নামে খায় যে ঘুষ
মরার পরে হয় যে হুঁশ।
তেলী মাথায় ঢালে তেল
শুকনা মাথায় ভাঙে বেল।
হায়রে অসৎ অফিসার বুঝে না।

এএইচ