টেলিটকের বড় প্রকল্পের টেন্ডারে ব্লাক লিস্টেট কোম্পানিও
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৪৯ পিএম, ৪ মার্চ ২০২৫ মঙ্গলবার

জনগণকে আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ফোর-জি মোবাইল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে চায় টেলিটক। কিন্তু বেধে দেওয়া কিছু নিয়ম নীতির বেড়াজালে সঠিকভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। যে তিনটি কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নেচ্ছ তাদের প্রত্যেকটিই সমস্যাযুক্ত। ফলে চলমান টেন্ডার বাতিল করে প্রক্রিয়াটি আবার নতুন করে শুরু করার কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, চীন ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জি টু জি অর্থায়নে হতে যাওয়া প্রকল্পটিতে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে চীন আর নয়শ কোটি টাকার বেশি অর্থের যোগান দিবে বাংলাদেশ। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি)মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম নির্ধারিত করে দেয়া হয়। কোম্পানিগুলো হলো চায়না ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন করপোরেশন (সিআইটিসিসি), ইউনান কন্সট্রাকশন এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং গ্রুপ (ওয়াইসিআইএইচ), ও চায়না মেশিনারীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন কোম্পানি (সিএমইসি)।
এরপর গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে যে দরপত্র আহবান করা হয় সেখানে বলা হয়, অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি দরপত্রে অংশগ্রহণ করার জন্য টেন্ডার সিকিউারিটি অর্থাৎ দরপত্রের নিরাপত্তা অর্থ ৩০লাখ ইউএস ডলার জমা দিতে হবে। এবং এটাও বলা হয় যে, সকল কোম্পানিকে শুধুমাত্র একক পণ্য প্রস্তাব করতে হবে, কোন বিকল্প পণ্য দেয়া যাবে না। অর্থাৎ একই প্রযুক্তিসম্পন্ন কেবল একটি পণ্যই থাকতে পারবে, একাধিক কোম্পানির পণ্য উল্লেখ করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে এই দরপত্র প্রক্রিয়া দুই ধাপে সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের দরপত্র দুটি আলাদা বাক্সে বা খামে জমা দিতে হবে। যার শুরুতে থাকবে প্রস্তাবিত পণ্যের কারিগরী বিবরণ। অন্যটিতে থাকবে আর্থিক প্রস্তাব। দরপত্র কমিটি প্রথমে পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের কারিগরী সক্ষমতা মূল্যায়ন করবে। শুধুমাত্র কারিগরী মূল্যায়নে যোগ্য আবেদনকারীদেরই আর্থিক দরপত্র বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু চায়না কোম্পানিগুলোর জমা দেওয়া দরপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনটি কোম্পানিই নিয়ম লঙ্গন করেছে। এদের মধ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন করপোরেশন (সিআইটিসিসি) ও ইউনান কন্সট্রাকশন এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং গ্রুপ (ওয়াইসিআইএইচ) দরপত্র জমা দেয়ার সময় কোনো নিরাপত্তা অর্থ জমা দেয়নি। পাশাপাশি প্রত্যেকটি পণ্যের আলাদা- আলাদা নাম ও দাম উল্লেখ করার কথা থাকলেও সে শর্তও পূরণ করেনি এই দুই চাইনিজ কোম্পানি। আবার অন্যদিকে দরপত্র জমা দেওয়ার সময় তারা কারিগরী ও আর্থিক প্রস্তাব আলাদা না দিয়ে সবকিছু একসঙ্গে জমা দিয়েও নিয়ম লঙ্গন করেছে ।
প্রকল্পটির টেকনিক্যাল ইভ্যালুয়েশন কমিটির সদস্য ড. ফোরকান বলেন, চায়না ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন করপোরেশন (সিআইটিসিসি) ও ইউনান কন্সট্রাকশন এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং গ্রুপ এই দুই কোম্পানি অভিজ্ঞ। তাদের জানা থাকার কথা একটি দরপত্রে কীভাবে অংশ নিতে হয়। মনে হচ্ছে যেভাবে তারা দরপত্র জমা দিয়েছে যে ভুলটা অনেকটা ইচ্ছাকৃত। এখানেই অনুমান করা যায় কোনো প্রভাবকের ভূমিকা রয়েছে।
এই প্রভাবকের তীরটা গিয়ে পড়ছে সিএমইসি’র ওপর। কারণ অন্য দুই কোম্পানি বাদ পড়লে কাজটি যাবে তাদের পকেটে। এক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে তারা। বিকল্প পণ্য প্রদান করা যাবে না জেনেও একাধিক অখ্যাত কোম্পানির বিকল্প পণ্যের কথা উল্লেখ করেছে।
প্রসঙ্গত,চায়না মেশিনারীজ কোম্পানি এর আগেও এশিয়াতে নানা কাজে অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে। ২০১৩ সালে বিটিসিএলের ইন্সটোলেশন অফ এনজিএন বেসড, টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল বাংলাদেশ ( এনটিএন) কাজ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল (সিএমইসি) কিন্তু সেই মূহুর্তে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দুর্নীতির কারণে চীন সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এলে বিটিসিএলও প্রায় ১৮২ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি ভেস্তে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে বিকল্প রাখার মানে হচ্ছে নিজের সুবিধামতো কম দামে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ করার অভিপ্রয়াস। অন্য দু্ই প্রতিষ্ঠান পরিস্কারভাবেই নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে আর এই অবস্থায় চায়না মেশিনারীজের এই অভিপ্রয়াস পর্যালোচনা করলে এই তিন কোম্পানির যোগসাজশের ধারণা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এই অবস্থায় টেলিটক পড়েছে বিপাকে। নতুন করে দরপত্র আহবানের চিন্তা করছে তারা। কিন্তু সীমিত এই দরপত্রের বেধে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আবারও দরপত্র আহবান করলে তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সন্দেহের দেখা দিয়েছে। টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এই প্রকল্পের হেড অব প্রকিউরমেন্ট এনটিটি নুরুল মাবুদ বলেন, তিনটি কোম্পানি দরপত্রের নিয়ম ভেঙ্গেছে। তাই কারিগরী মূল্যায়ন কমিটি সকলকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। যার ফলে এই দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বানের চিন্তা করছি আমরা। সেক্ষেত্রে আমরা এই তিন কোম্পানির মধ্যেই আবারো দরপত্র আহবান করবো নাকি নতুন কোম্পানি আসবে সে বিষয় নির্দেশ চেয়ে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) ও ইআরডিকে চিঠি দিয়েছি। ’’
অন্যদিকে সিপিটিইউ বলছে, ‘‘নতুন দরপত্রে টেলিটক কাকে আহবান করবে সেটা টেলিটকের নিজস্ব এখতিয়ার।’
একই কথা বলছে ইআরডি। তাঁদের মতে, টেলিটক যদি এই ইপিসি’র মধ্যে কোন পরিবর্তন চায় তাহলে সেটা টেলিটকের কাজ ইআরডি জানানোর। সেই অনুযায়ী ইআরডি চীন সরকারের সাথে আলোচনা করে সমাধান চাইবে।
প্রযুক্তি মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমিত দরপত্রের মধ্যে যদি আবারও এই তিনটি কোম্পানি অংশ নেয় তাহলে এখানে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ এমনকি আরো বড় দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীনের অন্যান্য কোম্পানির অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরী করা দরকার।
সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় এই সীমিত দরপত্রটি একটি সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। অংশীজন ও বিশ্লেষকদের মতে, এই বড় বাজেটের অর্থবহ প্রকল্পের স্বার্থকতা নিশ্চিতে দরপত্রে আরো যোগ্য ও পেশাদার প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
/আআ/