‘মাথাব্যথা’ রক্ষীবাহিনী, প্রধান আমেরিকায় কেন?
শেখ সাদী
প্রকাশিত : ০৯:১১ এএম, ৭ আগস্ট ২০২২ রবিবার
বিমান বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
৭ আগস্ট। বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ৯টায় সুইজারল্যান্ডের নয়া রাষ্ট্রদূত পরিচয়পত্র পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডের রূপ দেয়ার স্বপ্নের কথা বললেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও ১১টায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী সাক্ষাৎ করেন। এরা দুজনে পরে মোশতাকের মন্ত্রী হন।
দুপুর ১২টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন দেখা করেন।
বিকেল সাড়ে ৫টায় দেখা করলেন ভারতের হাইকমিশনার সমর সেন।
সাক্ষাতের সময়ে সমর সেন সতর্ক করেছিলেন। বললেন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। সন্ধ্যা ছয়টায় জাতীয় কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় সদস্য আবদুল আওয়াল এবং ছয়টা ১০ মিনিটে কাজী মোজাম্মেল হক এমপি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আজ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন সমর সেন
২
‘মাথাব্যথা’ রক্ষীবাহিনী
সিআইএ এবং খন্দকার মোশতাক চক্রের একটি বড় মাথাব্যথা ছিল রক্ষীবাহিনী। রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তাই, বঙ্গবন্ধু হত্যার নকশা তৈরিতে রক্ষীবাহিনীর উপর নজর দেয় খুনিচক্র।
প্রথেমে রক্ষীবাহিনীকে জনগণের সামনে হেয় করে তোলে।
সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করে এবং রক্ষীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য চক্রান্ত শুরু হয়।
রক্ষীবাহিনীর প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি কোর্সের প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আর তৎক্ষণাৎ গুজব রটানো হয় রক্ষীবাহিনীর জন্য ট্যাংক যোগাড় করতে বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামান বিদেশ যাচ্ছেন।
বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে উড়াল দেন ১১ আগস্টে।
এসময় রক্ষীবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুখ্যসচিব রুহুল কুদ্দুস। এই সময় তিনিও লন্ডনে। ফলে রক্ষীবাহিনীর অবস্থা তখন অনেকটা কাণ্ডারীহীন নৌকার মতো।
এ অবস্থায় ফারুকের ট্যাংকের সামনে দাঁড়াতে পারবে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল ফারুক গং। খুনিচক্র ধরেই নিয়েছিল, রক্ষীবাহিনীর শিবিরে ট্যাংকের উপস্থিতিতে রক্ষীদের হাতের রাইফেল পড়ে যাবে।
রক্ষীবাহিনী প্রধান বিগ্রেডিয়ার নূরুজ্জামান
বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে লন্ডনে জানলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। তখন আর কিছুই করার ছিল না। সিআইএ যে রক্ষীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ১৫ই আগস্টের আগে বাহিনীর প্রধানকে আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এটা এখন অত্যন্ত পরিষ্কার।
বিগ্রেডিয়ার নুরুজ্জামানের আমেরিকার যাওয়াটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিলো ওই সময়ে। সেই রহস্য পরে উন্মোচিত হয়েছে।
সেই রহস্যের বিস্তারিত আগামীকাল।
৩
সমর সেন যা বললেন
জুন ১৯৭৪ থেকে নভেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন সমর সেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি এ দেশে। দায়িত্বরত অবস্থায় ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে এক হত্যাচেষ্টায় আহত হন সমর সেন। ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় লিখেছেন, ‘ভারতের দ্বিতীয় হাইকমিশনার হিসেবে বাংলাদেশে আমার নিয়োগটি নিজের পছন্দমতোই হয়। আমার আগ্রহের কারণ ছিল বাংলাদেশে নবযুগের সূচনার সাক্ষী হয়ে থাকা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তিনটি চরম উদ্বেগজনক বিষয় আমার চোখে ধরা পড়ে।’
‘অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশটিকে তছনছ করে দিয়েছিল। যুদ্ধের কারণে জনগণ চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত যোগ হয়ে অবস্থা আরও খারাপ করে তোলে।’
‘দ্বিতীয় যে ধাক্কাটি আমি খেলাম তা রাজনৈতিক। সেখানে যেমন ব্যাপক আকারে ভারতের প্রতি প্রীতি ছিল, তেমনি বিপুল বিদ্বেষও কাজ করছিল। কারণগুলো অবশ্য পরে বোঝা যায়। পাকিস্তানপন্থীরা প্রচার চালাচ্ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থে নয়, ভারতের স্বার্থেই প্ররোচিত হয়ে কাজ করেছিল। ভারত যা করেছে তা নিতান্ত তার আপন স্বার্থে করেছে। ঠিক আছে, ভারত যদি আপন স্বার্থেই বাংলাদেশকে সাহায্য করে থাকে, তা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে হয়, সে সময় ভারত ও বাংলাদেশের স্বার্থ মিলে গিয়েছিল। আমি পরে বুঝতে পারি, এ ধরনের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও গণমাধ্যমে নিয়োজিত পাকিস্তানপন্থীরা। তাদের অনেকে তখনো এসব জায়গায় ঘাপটি মেরে ছিল।’
‘এছাড়া আরও কিছু উপদ্রবকারী গোষ্ঠী ভারত ও বাংলাদেশের সমঝোতার সম্পর্কে চিড় ধরায়। ফারাক্কা বাঁধ এবং বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার কথা এমন কিছু অঞ্চলের বিষয় ধরে তারা পানি ঘোলা করতে থাকে। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় ভারতের দখলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এবং উভয় দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।’
এ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হলো পাকিস্তানের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের অভিঘাত।
‘১৯৭৪। আগস্ট মাসে তাঁর বাংলাদেশে আসা ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মোহভঙ্গ ঘটারই আলামত— ভারতের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ যদি সত্য না-ও হয়। এসবই হলো নেতিবাচক দিক। আর, ইতিবাচক দিক, শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগীদের মধ্যে ভারতের প্রতি ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর বোধ ছিল। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাঁরা বরং খুশিই ছিলেন।
সুতরাং, বুঝতে পারি, সমস্যা যা তা রয়েছে দৃশ্যপটের আড়ালে। কিন্তু তা যে কত মারাত্মক গভীরে চলে গেছে, সেটা আমরা বুঝতেই পারিনি। তাই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ঘটনাবলী আমাদের জন্য ছিল ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙার মতো ব্যাপার। এটা পরিষ্কার যে, ওই সমস্যাপূর্ণ বছরগুলোতে শেখ মুজিব রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে এক রাখতে পারেননি।
অন্যদিকে তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতির পিতা হিসেবে তিনি যেকোনো কিছু করতে পারেন। কিন্তু সেটা ছিল নিষ্ফল আশা। তাই অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির আশঙ্কা সেনাবাহিনীর মধ্যে সহিংসতা ও অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আর তিনি ভাবতে থাকেন, ওরা তো সবাই আমারই সন্তান, আমিই ওদের আবার একত্র করব।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ জায়গায় চলে যাওয়ায় তিনি একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে মনস্থ করেন। একদলীয় বাকশালীয় ব্যবস্থার জন্ম হয় এভাবেই। দল হিসেবে এটা কমিউনিস্ট ধরনের কিছু নয়। এটা ছিল শেখ মুজিবের নিজস্ব ধরনের জাতীয় রাজনৈতিক দল। কিন্তু এর পরিণতি ভালো হয়নি এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলও একে ভালো চোখে দেখেনি।’
সবকিছুর পর, সেটা ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। এর প্রভাবও পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বাংলাদেশকে নিজ নিজ পক্ষপুটে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। আমার ধারণা, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ছিল বেশি। কারণ, তারা সেখানে প্রচুর টাকা ঢেলেছিল এবং তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল বেশি দক্ষ। পাকিস্তানপন্থী মহল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করে।
‘এ সবকিছু মিলে দুটি প্রবণতা দেখা যেতে থাকে।’
‘একটি এই যে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ক্রমশ খোলামেলা রূপ ধারণ করে। দেশটির যাবতীয় সমস্যা, বিপর্যয় ও ঘাটতির জন্য ভারতকে দায়ী করা হতে থাকে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা শেখ মুজিবের প্রতি বিমুখ হন এবং তাঁর একচ্ছত্র অবস্থান ক্ষয়ে যেতে থাকে।’
‘এ অবস্থায়ই সেনাবাহিনীর ওই মেজররা নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেলেন। যতই বিরুদ্ধাচরণ করুক, শেখ মুজিব বাঙালিমাত্রকেই তাঁর সন্তান ভাবতেন এবং বিশ্বাস করতেন। নিজের মর্মান্তিক মৃত্যু সেই শিথিলতার চূড়ান্ত প্রতিফল হয়ে এল। আমরা বাংলাদেশের ভেতরকার সব পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতাম। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা—তাদের কাজকর্মের খবর আমরা অল্প কজনই জানতাম—তার পরও মুজিব-বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে।’
‘এদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রাখার ব্যাপারটি শেখ মুজিব ভালো চোখে দেখতেন না এবং আমাদের বলেছিলেন ওদের বিরত রাখতে। আমরা তা-ই করেছিলাম। আর পরিণামে অভ্যুত্থানের আগে আমরা বুঝতেই পারিনি, পরিস্থিতি কী পরিমাণ খারাপ হয়ে গেছে।’
‘এখন এসে মনে হয়, আগস্ট অভ্যুত্থান পরিষ্কারভাবে সে সময়কার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ফল। আগের বছরগুলোতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে এ রকমটাই ঘটার সম্ভাবনা ছিল।’
‘আমেরিকানরা ছাড়া অন্যদেরও এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। আমি এটা জোর দিয়েই বলছি। গবেষক লরেন্স লিফশুলৎজ এ বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। ভারতের প্রতি তাঁর বিশেষ সহানুভূতি থাকার কথা নয়। তিনি আমাদের দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না এবং তা বোঝার গরজও করতেন না। কিন্তু শেখ মুজিব হত্যার সঙ্গে মার্কিনদের যোগসাজশ প্রমাণে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, ওই অভ্যুত্থান সংঘটিত করায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। তাঁর এই সন্দেহের যথোপযুক্ত প্রমাণ তিনি বইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেবল এ থেকেই বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলা যায় না।’
‘আসলে এ ধরনের বিষয় কখনোই নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।’
‘এই হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখে যাওয়া ও অপেক্ষা করার পন্থা নিই। তবে একই সঙ্গে নতুন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের এই কৌশল ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই পছন্দ করতে পারেননি। তখন আমাদের চালচলন এমন হলো যে, আমরা সব পথই খোলা রাখলাম। আমরা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বোত্তম বাস্তবিক পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাদের প্রধান স্বার্থগুলো, ফারাক্কা বাঁধ অথবা বাংলাদেশের কাছে ভূমি হস্তান্তরের বিষয় ইত্যাদি বিসর্জন দিইনি।’
‘যদি বিপর্যয় না-ও হয়, এক অর্থে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি। সভ্য সমাজের রাজনৈতিক রীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবেও আমি মনে করি, দৃশ্যপট থেকে শেখ মুজিবের বিদায় এক বিপর্যয়কর ঘটনা। এরপরের মাসগুলোতে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এক চক্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার দৃষ্টিতে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। কোনো দেশে সহিংসতার বিকার দানা বেঁধে বসলে, সেখানে কারও সঙ্গে তোমার রাজনৈতিক মতের মিল হচ্ছে না, ব্যস, মেরে ফেলো, এই হয়ে যায় চল।’
‘দ্রুতই আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ফেলি।’
‘আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আমরা কখনোই সরাসরি বাংলাদেশের অস্থিতিশীল করা কিংবা সেখানে হস্তক্ষেপের কোনো কাজ করিনি। এ মনোভাব বাংলাদেশের দিক থেকেও প্রদর্শিত হয়েছে। অন্তত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশও ভারতের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপে শামিল হয়নি।’
এএইচএস//এনএস//