ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’: রবীন্দ্র সাহিত্যে বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব

অদিতি ফাল্গুনী

প্রকাশিত : ১১:৪৭ এএম, ৭ আগস্ট ২০২২ রবিবার | আপডেট: ০২:০৬ পিএম, ৭ আগস্ট ২০২২ রবিবার

সেই যখন ক্যাসেটের যুগ আর বেতারের, আশির দশকের শুরুর সেই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কণিকা বা মোহর...যে নামেই তাঁকে ডাকুন...সেই অসামান্য দৈবী গায়িকার কণ্ঠে প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার। ‘হৃদয়ের একুল ওকূল’ থেকে ‘ও যে মানে না মানা’ বা ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়’ থেকে শুরু করে ‘বারতা পেয়েছি মনে মনে’ বা ‘এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে’ অথবা ‘আনন্দধ্বনি বহিছে ভুবনে’ কি ‘বিপুল তরঙ্গে রে।’ 

তাঁর গানের কথা লিখতে গেলে শেষ হবার নয়। কোনটি ছেড়ে কোনটির কথা বলব? ‘নাচে শ্যামা তালে তালে’ বা ‘হে মোর দেবতা’সহ অসংখ্য গান। এর ভেতরেই বিশেষ করে...সেই বয়সে সেই গানের কথার সব অর্থ না বুঝলেও ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’ গানটি কেমন শিশু কানে আলাদা ভাবে ধরা দিত। সেই বয়সে মনে হতো যে কেন কেউ ‘মারের’ সাগর পাড়ি দিতে চাচ্ছে? 

সব শিল্পীরই যেমন সবলতার পাশাপাশি দূর্বলতাও আছে, কনিকার গানের কিন্নরীতুল্য কণ্ঠের পাশাপাশি একটু সানুনাসিক স্বরের কারণে তাঁর উচ্চারণ সুচিত্রা মিত্রের গানের উচ্চারণের মত স্পষ্ট নয়। আবার সুচিত্রার অত স্পষ্ট উচ্চারণ বা কণ্ঠের এক ধরণের পৌরুষ যেন রবীন্দ্র সঙ্গীতে যে প্রার্থিত নারী সত্ত্বা আমরা চাই গায়িকাদের কাছ থেকে...তার সাথে অতি সামান্য হলেও দূরত্ব তৈরি করে। তা’ একটু বড় হয়ে- ষোড়শী/সপ্তদশী যখন...বয়সের গুণেই ‘মারের সাগর’ বহুদিন আবার আমার কাণে বাজলো ‘মানের সাগর পাড়ি দেব গো’ হিসেবে।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাবলাম ‘অভিমানের সাগর‘ হয়তো। সবসময় ত’ ‘গীতবিতান’ মেলানো হয় না। আরো কিছু পরে ‘গীতবিতান’ মিলিয়ে দেখি সেই ‘মারের সাগর।’ তখন ভাবছি...প্রাপ্তবয়সী যে কারো মত ভাবছি যে এই ‘মারের সাগর’ অর্থ জীবনের নানা পরাজয়-অপ্রাপ্তি-হতাশার মার। গতকাল হুট করে মনে এলো...আচ্ছা...এই ‘মার’ কি গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব অর্জনের আগে পার্থিব সব কামনা-বাসনা-ভোগ-রিপু-মন্দত্বের প্রতীক হয়ে বুদ্ধের সাথে তীব্র লড়াইয়ে নিরত হননি? না, আগে বরং রবীন্দ্রনাথের মূল গানটিতেই চলে যাই। গানের কথাগুলো লক্ষ্য করি:

আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো
এই বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে
ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে গো
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী
ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে
পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, অভয় মনে ছাড়ব তরী
এই শুধু মোর দায় গো, এই শুধু মোর দায়
দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি গো
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল
দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে!
(https://sonichits.com/video/Kanika_Banerjee)/Ami_Marer_Sagor_Pari_Debo

গানটি শুনেছি বোধ করি আমার আট বছর বয়স থেকে। সেই শিশু বয়সে কিছুই না বুঝে যেমন কণিকার গলার প্রেমের গানগুলোও মোটামুটি সেই বয়সেই তীব্র অনুকৃতিতে তরুণী গায়িকার গলার আবেগও অবিকল ‘নকল’ করে গাইতাম, তেমনি ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’র কথাও কিছুই না বুঝে টুকটাক গাইতাম। 

এবার দেখা যাক যে কি লেখা আছে বৌদ্ধ দর্শনে? আসুন- একটু পড়ি। 

'বোধি লাভের তপস্যায় মন্দত্বের রাজা ‘মার’-এর সাথে বুদ্ধের সংগ্রাম'

সংস্কৃত ভাষায় মার (তিব্বতি ভাষায় উইলি) হলো সেই দানব যে কিনা বুদ্ধকে তাঁর বোধি অর্জনের সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত করার জন্য তাঁর তিনজন পরমা সুন্দরী কন্যাকে বুদ্ধের ধ্যান ভাঙাতে পাঠান। কেউ কেউ বলেন যে, মার তাঁর পাঁচ সুন্দরী কন্যাকে পাঠিয়েছিলেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী ‘মার’ হলো মানুষের প্রবৃত্তি, অদক্ষতা, ‘আত্মিক’ জীবনের মৃত্যুর প্রতীক। মানুষকে তাঁর আত্মিক জীবনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে পার্থিক লোভ-লালসায় মত্ত রাখাই ‘মার’-এর কাজ। বৌদ্ধ ধর্মে কামদেবতা ‘মার’কে চারটি অর্থে দেখা হয়:

ক্লেশ-মার, মার যখন সংসারে যাবতীয় অর্থহীন আবেগের প্রতিমূর্তি,
মৃত্যু-মার, মার যখন জন্ম ও মৃত্যুর বিরতিহীন চক্রে পুনরাবৃত্ত,
স্কন্ধ-মার, মার যখন পার্থিব অস্তিত্বের প্রতীক,
দেবপুত্র-মার, মার যখন প্রতীকী অর্থে সীমায়ত না থেকে এক নিরপেক্ষ অস্তিত্বের বাহক।

শুরুতে বৌদ্ধ ধর্মে মারকে আক্ষরিক ও ‘মনস্তাত্ত্বিক’ উভয় অর্থে দেখা হতো। ‘মার’ আসলে মানুষের আত্মিক সাধনার পথে নানা সন্দেহ ও প্রলোভনের মূর্ত রূপ। বৌদ্ধ ভাস্কর্যে ‘মারকে হারিয়ে বুদ্ধের জয়’ একটি জনপ্রিয় মুদ্রা। এই মুদ্রায় বুদ্ধকে দেখা যায় তাঁর বাম হাতটি কোলে রেখে হাতের তালুটি উপরের দিকে এবং ডান হাঁটুর উপরে হাত রাখতে। তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো মাটি ছুঁয়েছে। এ যেন মাটিকে মারের সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে বোধি অর্জনের বিষয়টি সাক্ষ্য মানা। এই মুদ্রাকে ‘ভূমিসম্পর্শী’ মুদ্রাও বলা হয়।

ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ‘মার’ শব্দটি Proto-Indo-European ধাতু ‘মের’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘মৃত্যু’। স্নাভিক ‘মারজানা’ এবং লাতভীয় ‘মারা’ থেকে এর উৎপত্তি। লাতভীয় পুরাণে ‘মারা’ অর্থ মা পৃথিবী যিনি কিনা প্রজ্ঞাময়ী এবং উদার। আবার স্নাভ ভাষায় ‘মারা’ অর্থ হলো শীত এবং মৃত্যুর দেবী। কারণ, মৃত্যু একটি সত্যিকারের পরিবর্তন বা রূপান্তর। ‘মার’-এর এই তিন কন্যার নাম হলো তানহা (বাসনা), আরতি (ক্লান্তি) এবং রাগ (আবেগ)। উদাহরণস্বরূপ ‘সমুত্ত নিকায়া’-তে বলা হয়েছে যে ‘মার’-এর তিন কন্যা সামনে এসেও বুদ্ধকে ভুলাতে পারলেন না।

অনিন্দ্য রূপসী তিন কন্যা
তানহা, আরতি আর রাগ-
পিতার নির্দেশে ছুটলো বুদ্ধের ধ্যান ভাঙাতে,
কিন্তু বুদ্ধ সরিয়ে দিলেন তাদের,
বাতাসের এক ফুৎকারে যেমন উড়ে যায়
দীর্ণ শিমুল তুলা।

কেউ কেউ আবার বলেন যে ‘মার’-এর এই পাঁচ কন্যার ভেতরে প্রথম তিনজন হলেন, আকর্ষণ, বিকর্ষণ ও মোহভঙ্গ এবং শেষের দুজন হলেন অহংকার ও ভয়।

বুদ্ধ ‘মার’-এর এই পাঁচ কন্যাকে হারিয়ে জয়ী হলেন তাঁর ‘বোধি’ অর্জনের লড়াইয়ে (গৌতম বুদ্ধ, অদিতি ফাল্গুনী)। 

তবে বুদ্ধ ও ‘মার‘-এর এই লড়াইয়ের সেরা বর্ণনা দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নালক‘ গ্রন্থে। আসুন, সেখান থেকে খানিকটা পড়ি। 
পাথরের বেদীতে কুশাসনে বসে সিদ্ধার্থ আজ প্রতিজ্ঞা করলেন, এ শরীর থাক আর যাক, দুঃখের শেষ দেখবই-দেখব —সিদ্ধ না হয়ে, বুদ্ধ না হয়ে এ আসন ছেড়ে উঠছি  না । বজ্রাসনে অটল হয়ে সিদ্ধার্থ আজ যখন ধ্যানে বসে বললেন--

‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদূর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।’

তখন ‘মার’ যার ভয়ে সংসার কম্পমান, যে লোককে কুবুদ্ধি দেয়, কুকথা বলায়, কুকর্ম করায়— সেই ‘মার’—এর সিংহাসন টলমল করে উঠল । রাগে মুখ অন্ধকার করে ‘মার’ আজ নিজে আসছে মার-মার শব্দে বুদ্ধের দিকে । চারিদিকে আজ ‘মার’-এর দলবল জেগে উঠেছে! তারা ছুটে আসছে, যত পাপ, যত দুঃখ, যত কালি, যত কলঙ্ক, যত জ্বালা-যন্ত্রণা, ময়লা আর ধূলা—জল-স্হল-আকাশের দিকে-বিদিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে । পূর্ণিমার আলোর উপরে কালোর পর্দা টেনে দিয়েছে— ‘মার’! সেই কালোর ভিতর খেকে পূর্ণিমার চাঁদ চেয়ে রয়েছে —যেন একটা লাল চোখ! তা থেকে ঝরে পড়ছে পৃথিবীর উপর আলোর বদলে রক্ত-বৃষ্টি! সেই রক্তের ছিটে লেগে তারাগুলো নিবে-নিবে যাচ্ছে।

আকাশকে এক-হাতে মুঠিয়ে ধরে, পাতালকে এক পায়ে চেপে রেখে, ‘মার’ আজ নিজমূর্তিতে সিদ্ধার্থের সামনে এসে দাঁরিয়েছে। তার গায়ে উড়ছে রাঙা চাদর, যেন মানুষের রক্তে ছোপানো! তার কোমরে ঝুলছে বিদ্যুতের তরোয়াল, মাথার মুকুটে দুলছে ‘মার’ এর প্রকাণ্ড একটা রক্ত মণির দুল, তার কানে দুলছে মোহন কুণ্ডল, তার বুকের উপর জ্বলছে অনল-মালা, আগুনের সুতোয় গাঁথা । বুক ফুলিয়ে ‘মার’ সিদ্ধার্থকে বলছে —বৃথাই তোমার বুদ্ধ হতে তপস্যা! উত্তিষ্ঠ —ওঠো! কামেশ্বরোহষ্মি-। আমি ‘মার’ । ত্রিভূবনে আমাকে জয় করে এমন কেউ নেই!  উত্তিষ্ঠ উত্তিষ্ঠ মহ্যবিষয়স্হং বচং কুরুষ্ব- ওঠো চলে যাও, আমাকে জয় করতে চেষ্টা কর না । আমার আজ্ঞাবাহী হয়ে থাক, ইন্দ্রের ঐশ্বর্য তোমায় দিচ্ছি, পৃথিবীর রাজা হয়ে সুখভোগ কর; তপস্যায় শরীর ক্ষয় করে কি লাভ? আমাকে জয় করে বুদ্ধ হওয়া কারো সাধ্যে নেই।” 

সিদ্ধার্থ ‘মার’-কে বললেন- “হে ‘মার’! আমি জন্ম-জন্ম ধরে বুদ্ধ হতে চেষ্টা করছি, তপস্যা করছি, এবার বুদ্ধ হব তবে এ আসন ছেড়ে উঠব, এ শরীর থাক বা যাক এই প্রতিজ্ঞা-

ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদূর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।’

তিনবার ‘মার’, বললে- “উত্তিষ্ঠ, চলে যাও, তপস্যা রাখ!” তিনবারই সিদ্ধার্থ বললেন, “না! না! না! নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।” রাগে দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করে বিকট হুঙ্কার দিয়ে তখন আকাশ ধরে টান দিলে ‘মার’! তার নখের আঁচড়ে অমন যে চাঁদ-তারায় সাজানো নীল আকাশ সেও ছিঁড়ে পড়ল শত টুকরো হয়ে একখানি নীলাম্বরী শাড়ির মতো । মাথার উপরে আর চাঁদ নেই, তারা নেই; রয়েছে কেবল মহাশুন্য, মহা অন্ধকার! মুখ মেলে কে যেন পৃথিবীকে গিলতে আসছে। বোধ হয় তার কালো জিভ বেয়ে পৃথিবীর উপর পড়ছে জমাট রক্তের মতো কালো নাল! ‘মার’ সেই অন্ধকার মুখটার দিকে দেখেছে কি আর বিদ্যুতের মতো দুপাটি শাদা দাঁত শূন্যে ঝিলিক দিয়ে কড়মড় করে উঠেছে; আর হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সেই সর্বগ্রাসী মুখের ভিতর থেকে ‘মার’ এর দল; চন্দ্র-সূর্য ঘুরছে তাদের হাতে দুটো যেন আগুনের চরকা! দশদিক অন্ধকার করে ঘুরতে ঘুরতে আসছে- ‘মার’ এর দল ঘূর্ণি বাতাসে ভর দিয়ে, পৃথিবী জুড়ে ধূলার ধ্বজা। তারা শুন্য থেকে ধুমকেতুগুলোকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ফেলছে আগুনের ঝাঁটার মতো। পৃথিবী থেকে গাছগুলোকে উপড়ে, পাহাড়গুলোকে মুচড়ে নিয়ে বন্‌-বন্‌ শব্দে ঘুরিয়ে ফেলছে তারা চারিদিক থেকে অনবরত শিলাবৃষ্টির মতো; লক্ষ লক্ষ ক্ষ্যাপা ঘোড়া যেন ঘুরে রেড়াচ্ছে ‘মার’ সৈন্য বুদ্ধদেবের চারিদিকে! তাদের খুর থেকে বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়ছে, তাদের মুখ থেকে রক্তের জ্বলন্ত ফেনা আঁজলা-আঁজলা ছড়িয়ে পড়ছে সেই রোধিবটের চারিদিকে, সেই পাথরের বেদীর আশেপাশে।

উরাইল-বনের প্রত্যেক গাছটি পাতাটি ফুলটি এমন কি ঘাসগুলিও আজ জ্বলে উঠেছে; জ্বলন্ত রক্তে অঞ্জনার জল ঘুরে ঘুরে চলেছে আগুন মাখা। বিদ্যুতের শিখায় তলোয়ার শানিয়ে মশাল জ্বালিয়ে, দলের পর দল যত রক্তবীজ, তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়ে পড়ছে আজ বুদ্ধদেরের উপরে। তাদের আগুন-নিঃশ্বাসে আকাশ গলে যাচ্ছে, বাতাস জ্বলে যাচ্ছে, পৃথিবী দেখা যাচ্ছে যেন একখানা জ্বলন্ত কয়লা, ঘূর্ণি বাতাসে ঘুরে-ঘুরে চলেছে আগুনের ফুলকি ছড়াতে-ছড়াতে; তার মাঝে জ্বলন্ত একটা তালগাছ ঘুরিয়ে 'মার’ ডাকছে—‘হান! হান!’ পায়ের নখে রসাতল চিরে জেগে উঠেছে মহামারী। আজ ‘মার’-এর ডাকে রসাতলের কাজল অন্ধকার কাঁথার মতো সর্বাঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে আর্তনাদ করে ছুটে আসছে— সে ‘মারী’। তার ধুলোমাখা কটা চুল বাতাসে উড়ছে আকাশ জোড়া ধূমকেতুর মতো! দিকে-দিকে শোকের কান্না উঠেছে, ত্রিভুবন থর-থর কাঁপছে! মহামারীর গায়ের বাতাস যেদিকে লাগল সেদিকে পাহাড় চূর্ণ হয়ে গেল, পাথর ধুলো হয়ে গেল, বন-উপবন জ্বলে গেল, নদী-সমুদ্র শুকিয়ে উঠল। আর কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না! সব মরুভূমি হয়ে গেছে, সব শুয়ে পড়েছে, নুয়ে পড়েছে, জ্বলে গেছে, পুড়ে গেছে, ধুলো হয়ে ছাই হয়ে উড়ে গেছে! জগৎ জুড়ে উঠেছে ‘মারী’র আর্তনাদ, ‘মার’-এর সিংহনাদ, আর শ্মশানের মাংস-পোড়া বিকট গন্ধ।

তখন রাত এক প্রহর। ‘মার’-এর দল, ‘মারী’র দল উল্কামুখী শিয়ালের মতো, রক্ত আঁখি বাদুড়ের মতো মুখ থেকে আগুনের হলকা ছড়িয়ে চারিদিকে হাহা হুহু করে ডেকে বেড়াচ্ছে, কেঁদে বেড়াচ্ছে! আকাশ ঘুরছে মাথার উপর, পৃথিবী ঘুরছে পায়ের তলায় ঘর্ঘর শব্দে যেন দুখানা প্রকাণ্ড জাঁতার পাথর বুদ্ধদেবকে পিষে ফেলতে চেষ্টা করছে! ‘মার’ দুহাতে দুটো বিদ্যুতের মশাল নিয়ে বুদ্ধদেবকে ডেকে বলছে-‘পালাও, পালাও, এখনো বলছি তপস্যা রাখ!’ বুদ্ধদেব ‘মার’র দিকে চেয়েও দেখছেন না, তার কথায় কর্ণপাতও করছেন না। ‘মার’র মেয়ে ‘কামনা’, তার ছোট দুইবোন ‘ছলা-কলা’কে নিয়ে বুদ্ধদেবের যোগভঙ্গ করতে কত চেষ্টা করছে কখনো গৌতমী মায়ের রূপ ধরে, কখনো যশোধরার মতো হয়ে বুদ্ধদেবের কাছে হাত-জোড় করে কেঁদে-কেঁদে লুটিয়ে পড়ে! তাঁর মন গলাবার, ধ্যান ভাঙাবার চেষ্টায় কখনো তারা স্বর্গের বিদ্যাধরী সেজে গান গায়, নাচে, কিন্তু বুদ্ধদেবকে ভোলাতে আর পারে না। বজ্রাসনে আজ তিনি অটল হয়ে বসেছেন, তাঁর ধ্যান ভাঙে কার সাধ্য! যে ‘মার’-এর তেজে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কম্পমান, যার পায়ের তলায় ইন্দ্র-চন্দ্র-বায়ু-বরুণ, জল-স্হল-আকাশ সেই ‘মার’র দর্পচুর্ণ হয়ে গেল আজ বুদ্ধের শক্তিতে! ‘মার’ আজ বুদ্ধের একগাছি মাথার চুলও কাঁপাতে পারলে না, সেই অক্ষয়বটের একটি পাতা, সেই পাথরের বেদীর একটি কোণও খসাতে পারলে না! বুদ্ধের আগে ‘মার’ একদণ্ডও কি দাঁড়াতে পারে। বুদ্ধের দিকে ফিরে দেখবারও আর তার সাহস নেই। দুই হাতের মশাল নিবিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে ‘মার’ আস্তে-আস্তেপালিয়ে গেছে-নরকের নীচে, ঘোর অন্ধকারে, চারিদিক কালো করে। বুদ্ধদেব সেই কাজল অন্ধকারের মাঝে নির্ভয়ে একা বসে রয়েছেন, ধ্যান ধরে প্রহরের পর প্রহর। রাত শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু ‘মার’র ভয়ে তখনো পৃথিবী এক-একবার কেঁপে উঠছে—চাঁদও উঠতে পারছে না, সকালও আসতে পারছে না। সেই সময় ধ্যান ভেঙে ‘মার’কে জয় করে সংসার থেকে ভয় ঘুঁচিয়ে বুদ্ধ দাঁড়ালেন। তিনি আজ সিদ্ধ হয়েছেন, বুদ্ধ হয়েছেন, দুঃখের শেষ পেয়েছেন। ডান হাতে তিনি পৃথিবীকে অভয় দিচ্ছেন, বাঁ-হাতে তিনি আকাশের দেবতাদের আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁর সোনার অঙ্গ ঘিরে সাতরঙের আলো। সেই আলোতে জগৎ-সংসার আনন্দে জয়-জয় দিয়ে জেগে উঠেছে, নতুন প্রাণ পেয়ে, নতুন সাজে সেজে। বুদ্ধের পায়ের তলায় গড়িয়ে চলেছে নৈরঞ্জন নদীটি একূলে ওকূলে শান্তিজল ছিটিয়ে  (http://www.abanindranath.org/2472249424822453.html)। 

তবে এই ‘মার’র সাথে সংগ্রাম অত সহজ নয়। ধরা যাক, আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে আমার কেশদাম কর্তন করে ক্যান্সার রোগীদের দেব (আমার বড় ভাগ্নি প্রায়ই এটা করে)। আবার এই আমার ভেতরেই দীর্ঘ কেশদাম পরিচর্যা করার সুপ্ত বাসনাও রয়েছে। ধরা যাক, দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজভস’এ সন্ন্যাসীপ্রতিম আলিওশা আর তার্কিক ও নৈরাজ্যবাদী ইভানের দুই চরিত্র পড়ে আপনার চেনা-আধ চেনা মানুষের ভেতরই আপনি এমন দুই চরিত্র পেলেন। আলিওশাকে তর্কাতীতভাবে সন্ন্যাসীপ্রতিম জেনেও নৈরাজ্যবাদী ইভানের প্রতিও যে আপনার সামান্য কৌতূহল হবে না তা’ কিন্ত নয়। পার্সি পুরাণে এটাই ‘অহুর মজদা (আলোর সৃষ্টিকর্তা)’ ও ‘আহিরি মান (অন্ধকারের শয়তান)’এর ডিকোটমি। নিজেরই সত্ত্বার ভেতরে এই লড়াই স্বয়ং বুদ্ধকেই করতে হয়েছে। আর আমরা তো কোন ছার!

রবীন্দ্র সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের জীবন ও দর্শণের গুরুত্ব এমনিতেও কম নয়। ‘রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কন্থা/বিষয় বিবাগী পথের ভিক্ষুক/মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে প্রত্যহের কুশাঙ্কুর’ থেকে ‘উপগুপ্ত ও বাসবদত্তা’ জাতকের কাহিনী অবলম্বনে ‘অভিসার’ নামে দীর্ঘ কবিতা, ‘শ্যামা’ জাতকের অবলম্বনে ‘শ্যামা’ গীতি ও নৃত্য নাট্য অথবা বুদ্ধেরই কাকাতো ছোট ভাই সন্ন্যাসী আনন্দ ও চন্ডালিনী মাতঙ্গ (প্রকৃতি)-র জীবন অবলম্বনে ‘চন্ডালিনী’ গীতি ও নৃত্য নাট্য। সেসব সবিস্তারে লেখা যাবে কখনো অথবা সে কাহিনীগুলো সবাই মোটামুটি জানেনই। 

লেখক: উন্নয়নকর্মী, কবি, কথা সাহিত্যিক ও অনুবাদক

এএইচএস/এনএস