অবৈধ শ্রমিক ফেরত পাঠানোয় সৌদিআরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত
প্রকাশিত : ০৪:১৮ পিএম, ৪ জুলাই ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:১৬ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৭ মঙ্গলবার
মোহাম্মদ ফিরোজ, সৌদিআরব প্রতিনিধি : বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। গত তিন চার বছরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যে এই বাজার বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকলেও বর্তমানে এই বাজার খুলে গেছে। অবৈধ প্রবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কারণে বাংলাদেশের কিছুটা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমলেও তার সুফল পাওয়া যাবে ভিসার দ্বার উন্মুক্ত হওয়াতে।
আগে সৌদি সরকার ইকামা পরিবর্তন ও অবৈধদের বৈধ হওয়ার যে সুযোগ দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এবারের `এ নেশন উইদাউট ভায়োলেটরস’ কর্মসূচি তিনমাস অতিবাহিত হওয়ার পর আরও এক মাস সময় বধির্ত করেছে সৌদি সরকার।
প্রায় ২৫ লাখ অবৈধ অভিবাসী ও অবৈধ শ্রমিক আগের ওই সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশিও ছিলেন।
বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেদ্দার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৪ লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন, যার মধ্যে ৬০ হাজার নারী কাজ করছেন গৃহকর্মী হিসেবে। এ হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার।
বর্তমান সৌদি সরকার অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ‘এ নেশন উইদাউট ভায়োলেটরস’ আউট পাশের ব্যবস্থা করেন এবং গত ২৬ জুন শেষ হয়ে আরও এক মাস মেয়াদ বাড়িয়ে হিজরী মাসের ১ শাওয়াল থেকে ১ রজব পযর্ন্ত এই সময় বধির্ত করা হলো। ঐ সময়ে প্রাপ্ত আউট পাশে এখন অনেকে দেশে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে। এই আউট পাশের সুযোগ বেশীরভাগ অবৈধ বাংলাদেশি নিয়েছেন। কারণ এই সুযোগের ফলে অবৈধ শ্রমিক দেশে ফেরত গিয়ে আবার নতুন ভিসায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি কিছু ফেরত গিয়ে আবার নতুন ভিসায় সৌদিআরব চলে আসছেন। যারা এই সুযোগ গ্রহণ করবেন না তাদের সৌদি শ্রম আইন অনুযায়ি শাস্তির আওতাধীন নিজ করছে দেশে ফেরত যেতে হবে।
এই ব্যাপারে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট লেবার কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক এই পর্যন্ত জেদ্দা কনসুলেট থেকে ১৮৩৯৮ জন আউটপাস সংগ্রহ করে এবং রিয়াদ দূতাবাস থেকে ১৯৮৮২ জন আউটপাস সংগ্রহ করে দেশে চলে গেছেন। এখনো যারা আউটপাস সংগ্রহ করেননি তারা যেন এই সুবিধা গ্রহণ করে দেশে ফেরত গিয়ে আবার নতুনভাবে আসার সুযোগ গ্রহণ করেন অন্যথায় সৌদি আইনে কঠোর শাস্তির আওতায় আসতে হবে এবং নিজ খরচে দেশে যেথে হবে।
অবৈধ শ্রমিক দেশে ফেরত যাওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, অবৈধ শ্রমিক এমনিতে অবৈধ তারা বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে পারতেন না। এই সব শ্রমিক অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমেই দেশে টাকা পাঠাতেন যা বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব হারাত। বর্তমানে তারা যদি এই সুবিধা গ্রহণ করে নতুন ভিসায় আসে তাহলে আমাদের দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে সৌদিআরবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো বৃদ্ধি পাবে।
আর যারা এখনও ‘এ নেশন উইদাউট ভায়োলেটরস’ সুবিধা গ্রহণ করেননি তাদের এই বর্ধিত সময় শেষ হওয়ার আগেই এই সুযোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান বাংলাদেশ দূতাবাস রিয়াদ ও জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেদ্দা।
২০০৮ - ২০১৫ সালে অনেকে সৌদি এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি এখন অবৈধ হয়ে সৌদি আরব আছেন। তাদের এই অবৈধ হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল হুরুব, কপিল পরিবর্তন/ ট্রান্সফার। হুরুব মানে কফিলের সাথে শ্রমিকদের মতের অমিল হলে শ্রমিকদের ফাইনাল এক্সিট করি দেয় স্পন্সর। আর শ্রমিকেরা এক্সিট পাওয়ার পরে দেশে চলে না গিয়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে গিয়ে কাজ করে অবৈধভাবে।
এইভাবে অনেক নিজের স্পন্সরের কাছে না থেকে বাইরে কাজ করতে গিয়ে অবৈধ হয়েছে।
দেখা গেছে, নামে মাত্র বেতনে স্পন্সরের কাছে কাজ করতে এসে অনেকেই অনায়াসে অন্যত্র কাজের খোঁজে চলে যায় এবং কাজ পেয়েও যায়। তখন সে আর স্পন্সরের কাছে ফিরে যায় না। অনেক সময় স্পন্সর’রা তাকে না পেয়ে মামলা করে দেয় তখন সহজাত ভাবেই সে অবৈধ হয়ে যায়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সৌদি আরবে অবৈধ হয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল। সৌদি সরকার এসব অবৈধ অভিবাসীদের আগে তেমন কোনো সমস্যা করত না, কাজের ক্ষেত্রে তেমন বাধা দিতনা। যার ফলে অবৈধভাবে প্রচুর শ্রমিক কাজ করে গেছে। কিন্ত বর্তমানে সৌদি সরকার অবৈধ অভিবাসীদের সেই সুযোগ বন্ধ করে তাদের নতুন ভিসায় আসার সুযোগ দিচ্ছে। এই সুযোগ দেওয়ার আগে যারা অবৈধ ছিল এবং সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ত তারা পাঁচ বছরের জন্য সৌদিআরবের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু বর্তমান সরকার অবৈধ অভিবাসীদের জন্য আউট পাশের সুযোগ করে পুনরাগমনের সুযোগ করে দেওয়াই অবৈধ শ্রমিকেরা এই সুযোগ গ্রহণ করছে বলে জানিয়েছেন।
অবৈধ বাংলাদেশি কিছু শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ইন্ড্রাস্টিয়াল এলাকায়, (সানাইয়া ) বিভিন্ন দোকানে এবং অনেকে, দরজির কাজে প্রায় লক্ষাধিক অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন। এদের অনেকেই বাংলাদেশি কন্ট্রাক্টারের মাধ্যমে কাজে নিয়োজিত। সেই কন্ট্রাক্টাররা মুলত ম্যান পাওয়ার ব্যবসার সাথে জড়িত। রিয়াদ, দাম্মাম, জেদ্দা, মক্কা, মদিনাসহ বিভিন্ন প্রদেশে এইসব শ্রমিক কর্মরত ছিলেন।
আউটপাস নিতে আসা কিছু অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকের সাথে কথা বলে জনা যায়, তারা বিভিন্ন কৌশলে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন সৌদি আরবে। এমনই একজন চট্টগ্রাম সাতকানিয়ার ইব্রাহিম। গত পাঁচ বছর আগে ওমরাহ ভিসায় সৌদিআরব এসে আর দেশে ফেরত জাননি।
তিনি একটি দরজি কারখানায় কর্মরত ছিলেন এতদিন। কিভাবে বাংলাদেশে তিনি টাকা পাঠাতেন তার কাছে জানতে চাইলে তিনি সরাসরি বলেন, আমি অবৈধভাবে বসবাস করাতে টাকা পাঠাতে খুব সমস্যা ছিল। যার দরুণ আমি হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠাতাম।
কুমিল্লার আব্দুল জব্বার। তিনি গত তিন বছর যাবত সৌদি আরবে অবৈধ কৃষি কাজে কর্মরত ছিলেন। গতকাল আউটপাস নিতে আসলে তার কাছে জানতে চাইলাম কেন তিনি সৌদি সরকারের বেধে দেওয়া সময় ৯০ দিনের মধ্যেই আউটপাস সংগ্রহ করেনি।
জবাবে তিনি বলেন, আমি দূর্গম পাহাড়ের ভিতর মাঝরাতে( কৃষি) কাজ করতাম। আমি কখনো শুনতে পাইনি এই সুযোগের কথা। ঈদের আগে আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় চলে আসাতে আমি জানতে পারলাম। তাই আমি বর্ধিত এই সুযোগ গ্রহণ করে দেশে ফেরত যেথে চাই। অবৈধভাবে কাজ করা অনেক কষ্ট। সব সময় মনে ভয় কাজ করে কখন পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। তার চেয়েও দেশে টাকা পাঠাতে খুব কষ্ট হত। পরিবারে একমাসে টাকা পাঠালে অন্য মাসে সমস্যা হত। কারো হাতে পায়ে ধরে দেশে টাকা পাঠাতাম। সময় সময় অবৈধ শ্রমিক হওয়াতে মালিক এর কাজ থেকে বেতনও পেতাম না। আমি সবার কাছে অনুরোধ করব যারা অবৈধভাবে সৌদিআরব বসবাস করছে তারা যেন এই সুযোগ নিয়ে দেশে চলে যান।
কক্সবাজারের ফোরকানারা পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে গত তিন বছর যাবত অবৈধভাবে বসবাস করছেন। ফোরকানারার স্বামী নুরুল হুদা গত আট মাস আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। এতদিন ফোরকানা ভাই আর বোনের সাথে ছিলেন। বর্তমানে এই সুযোগ পেয়ে তিনি দেশে চলে যাচ্ছেন। এতদিন কেন এই সুযোগ গ্রহণ করেননি জানতে চাইলে ফোরকানারা বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাচ্চাদের লেখাপড়ার দিকে তাকিয়ে আমি দেশে চলে যাইনি। বর্তমান বর্ধিত এই সময় পেয়ে আমি দেশে চলে যাওয়ার জন্য আউটপাস সংগ্রহ করেতে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আসছি।
এইভাবে অনেক শ্রমিক এখনও আউটপাস সংগ্রহ করেছেন বলে জানান বাংলাদেশ দূতাবাস ও জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট।
অবৈধ শ্রমিকদের কোনো কাগজপত্র না থাকাতে তারা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে পারতেন না। একদিকে যেমন বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব হারাত অন্যদিকে সৌদিআরবে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হচ্ছিল বলে মনে করেন বৈধ প্রবাসী শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ যেখানে রেমিটেন্সের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, বর্তমানে সৌদি আরবের ভিসার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়াতে বাংলাদেশের জন্য এটি সুফল বয়ে আনবে। এই খাতের দিকে বাংলাদেশ সরকারের গভীর মনযোগের দরকার। যাতে করে দক্ষ শ্রমিক দিয়ে একটি শক্তিশালী শ্রম বাজার গড়ে তোলা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টো চিত্র। দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর নামে কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির ফ্রি ভিসার নামে ছয়/শাত লাখ টাকা নিয়ে সৌদিআরবে লোক পাঠাচ্ছেন এই দিকে সরকারের নজরদারি করা অতি জরুরি।
অদক্ষ শ্রমিক আর ফ্রি ভিসার নামে যে লোকগুলো আসচ্ছে তারা এই দেশে এসে এইদেশের নিয়ম কানুন না মেনে নিজেদের মতো চলতে গিয়ে অতীতে এবং বর্তমানে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এবং করে আসছে। এসব ব্যাপারে সরকারের অনেক ভুমিকা থাকে। দূতাবাসের মাধ্যমে নিয়মিত নজরদারী করার দরকার হয়। কিন্তু আমাদের দূতাবাস জনবলের অভাবে তা করতে পারছে না।
ডব্লিউএন