ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর উপনিবেশিক শিক্ষাদর্শন

মাসুদ মাযহার

প্রকাশিত : ১২:৩১ পিএম, ৯ জুলাই ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৩:৪৪ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৭ সোমবার

ছবি: মাসুদ মাযহার

ছবি: মাসুদ মাযহার

রবীন্দ্রনাথের নায়কত্ব আজ ক্ষুণ্ন, রবীন্দ্রনাথ আজ অপ্রাসঙ্গিক- এ জাতীয় কিছু অর্বাচীন বক্তব্য স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। বাঙালির জীবদর্শনের গতিপথ নির্ধারণে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর কাব্য, উপন্যাস, নাটক, সংগীত প্রভৃতি সৃজনশীল শিল্পপ্রকরণ নিঃসন্দেহে বাঙালির নান্দনিক জীবনভাবনার অপরিহার্য অংশ। এই সত্যকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, তাঁর দর্শনচিন্তার বহুপ্রান্ত এখনও বিজ্ঞ গবেষকদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। এই অতলস্পর্শী বটবৃক্ষের দর্শনভাবনার প্রতিটি প্রান্ত উন্মোচন তাই আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি।

রবীন্দ্রনাথের দর্শনচিন্তা, সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনা, তার অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব, সমবায়, কৃষি ও গ্রাম উন্নয়ন প্রস্তাব, সংস্কৃতিভাবনা কিংবা শিক্ষাভাবনার গভীরতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা আজ পর্যন্ত হয় নি। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, গান প্রভৃতি সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের উপর যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে, তাঁর দর্শনভাবনার কিংবা মননশীল চিন্তার ক্ষেত্রে সেই তুলনায় সিকিভাগ কাজও হয় নি।

তাই বর্তমানে তরুণ সমাজের একটি বৃহৎ অংশের কাছে রবীন্দ্রনাথ কল্পলোকের আধ্যাত্মপুরুষ হিসেবে শ্রদ্ধা ভক্তি লাভ করছে ঠিকই কিন্তু জীবনভাবনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে এদেশে রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাসের পটভূমিতে। আলোচ্য প্রবন্ধের শুরুতেই এ দেশে রবীন্দ্রচর্চার প্রধান প্রবণতাসমূহ খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হবে। অতঃপর উত্তর-উপনিবেশিক (Post Colonialism) ডিসকোর্সের তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনায় তার প্রয়োগ দেখানো হবে। প্রবন্ধের শেষাংশে একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসেও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা কেন প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নের একটি যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

এক.

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুর পর থেকেই সরাস্বত মহল থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রশংসা লাভ করেছেন। একই সঙ্গে যৌক্তিক-অযৌক্তিক সমালোচনার শিকারও হয়েছেন অসংখ্যবার। ডিএল রায়, রজনীকান্ত সেন কিংবা শনিবারের চিঠি গোষ্ঠীর রবীন্দ্র বিরোধিতার কথা কারও অজানা নয়। পরবর্তীকালেও দেখা গেছে, বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে পড়ে নির্মোহ রবীন্দ্রচর্চা ব্যাহত হয়েছে। একদিকে চলে রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়ে রবীন্দ্রচর্চার নামে অন্ধ রবীন্দ্র পূজা, অন্যদিকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য রবীন্দ্র বিরোধিতা। দুটি পক্ষই এক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। রবীন্দ্র বিরোধী পক্ষের মধ্যে আবার দুইটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। একদল রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করেছেন ইসলামের দোহাই দিয়ে, আর একদল রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের ডাক দিয়েছেন মার্কসীয় শ্রেণি-চেতনার কথা বলে। “আমাদের শ্রেণী সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ মিত্রশক্তি নন”- এই ব্যাখ্যা দিয়ে কমরেড ভবানী সেনসহ কিছু অতিবাম উগ্র রবীন্দ্রবিরোধিতায় মেতে ছিলেন। অবশ্য তাদের এই ভুল ভাঙ্গতে খুব বেশি সময় লাগে নি।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পরপরই ধর্মের দোহাই দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের অপচেষ্টা জোরালো হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উচ্ছিষ্টভোগী কিছু বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের ডাক দেয়। এই গোষ্ঠীর মুখপাত্র সৈয়দ আলী আহসান এই প্রসঙ্গে বলেন,

মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল স্বাতন্ত্রবোধের উপর ভিত্তি করে। ...নতুন রাষ্ট্রের স্থিতির প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ভাবধারার প্রকাশ খুঁজবো। সেইসঙ্গে এটাও সত্য যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়ত বা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয় আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন আমাদের বেশি।” (পূর্বপাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যের ধারা/মাহেনও)

পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে বাংলার মাটি থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেওয়ার অপচেষ্টা চলে। ১৯৬১ সালে কবির জন্ম শতবার্ষিকী পালনে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধা দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন সংসদে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয় বলে ঘোষণা দেন। এরপর রাতারাতি রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার ফলে বাঙালির মানসলোকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালবাসা তীব্র হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে কবি সুফিয়া কামাল, বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ, খান সরওয়ার মুর্শেদ প্রমুখের নেতৃত্বে কবির জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এ সময় প্রগতিশীল গবেষকদের হাত ধরে তার উপর একাডেমিক গবেষণার সূত্রপাত হয়। এক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন অগ্রপথিক। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্র সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পথকে সুগম করে। এভাবে বিপুল বিক্রমে রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসেন বাঙালির হৃদয়লোকে।

এই সময়ের রবীন্দ্রচর্চায় একটি আশ্চর্যজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু রবীন্দ্রপ্রেমী এ সময় রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলিম চেতনার প্রকাশ দেখাতে চেষ্টা করেন। আ ন ম বজলুল করিম রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলিম সুফী সাহিত্যের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। কাজী আবদুল ওদুদের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ’, আবুল ফজলের ‘মুসলিম স্বাতন্ত্র্য বোধ ও রবীন্দ্রনাথ’, গোলাম মোস্তফার ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘গল্পগুচ্ছের মুসলিম চরিত্র’, মজিবর উদ্দীন মিয়ার ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে মুসলিম সমাজ ও জীবন’, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক’, আনিসুজ্জামানের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ : একটি ভূমিকা’ প্রভৃতি প্রবন্ধকে একটি বিশেষ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

গবেষক আবুল মোমেন দেখিয়েছেন, এই সকল রবীন্দ্রপ্রেমী শাসকগোষ্ঠীর নিকট রবীন্দ্রনাথকে জায়েজ করার জন্য এই কাজ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, এটি ছিল একটি ভুল প্রবণতা। আবার এই সময় একটি বড় অংশ বিশেষত শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়ে শুরু করেন অন্ধ রবীন্দ্র পূজা। এই অংশটি রবীন্দ্রনাথকে বাস্তবতা বিবর্জিত আধ্যাত্ম্য পুরুষ হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। ফলে দেবকল্প রবীন্দ্রনাথের নিকট চিন্তাশীল ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ম্লান হতে থাকে। এতে করেও নির্মোহ রবীন্দ্রচর্চা আবার বাধাগ্রস্ত হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ-

 

গোড়া মতবাদীদের মতো আমরা যদি জেদ করে বলি যে, পূজ্যপাদ রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি শব্দ-শব্দাংশই অমোঘ সত্যের দ্যোতক, তাহলে তো আমরা ইসলামপন্থীদের মতোই স্রেফ একটিমাত্র সত্য আঁকড়ে থাকার গোড়ামির চেয়ে সুনিশ্চিতভাবেই উত্তম কিছু নই।” (বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাট্য সংকেত)

দুই.

সমকালীন জ্ঞানতত্ত্বে উত্তর-উপনিবেশবাদ একটি বহুল আলোচিত সমালোচনা তত্ত্ব (Critical Theory)। শব্দটি ইংরেজি Post Colonialism শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। বিশ্বের ইতিহাসে বাইরের দেশ কর্তৃক বিভিন্ন দেশকে শাসিত-শোষিত হতে দেখা যায়। একে উপনিবেশবাদ বলে। উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো যখন লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে উত্তর-উপনিবেশিক যুগে প্রবেশ করে সেই সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে উত্তর-উপনিবেশবাদ বলে। উপনিবেশের কবলমুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মানবীয় মাত্রা এবং এরই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির সার্বিক আত্মিক মুক্তি ও প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে এই তত্ত্বের মূল কথা।

সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি ভেদরেখা টেনে দিয়েছে- যার উপর ভিত্তি করে পশ্চিম তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে থাকে আর প্রাচ্যকে মনে করে হীন, দুর্বল, নিকৃষ্ট, বর্বর, অসভ্য, নিজেদের শাসনে ও প্রতিপালনে অক্ষম। কাজেই নিকৃষ্টদের সভ্য করে তোলার জন্য তাকে শাসন করার বৈধতা তাদের রয়েছে- এই যুক্তি দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের শাসন, আইন, ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। এই পশ্চিমী ভাবনার বিপরীত স্রোত হচ্ছে উত্তর-উপনিবেশবাদ। এই তত্ত্ব প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সম্পর্কের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখার দৃষ্টিকোণ এনে দেয়। এই ডিসর্কোসের মূল বক্তব্য হল- পশ্চিমের নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার কিছু নেই। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই সে এই শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব খাড়া করেছে মাত্র। প্রাচ্য নিজেও যে জ্ঞান গরিমার কোনো অংশে ন্যূন নয়- এই বোধের বিনির্মাণ এই তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিক। উত্তর-উপনিবেশবাদ তাই শুধু কোনো সাহিত্য সমালোচনা রীতি নয়, একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক তত্ত্ব।

রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ উপনিবেশিত সমাজ কাঠামোর পটভূমিতে বেড়ে উঠেছেন। উপনিবেশিত সমাজে বসবাস করেও তিনি উত্তর উপনিবেশিক চিন্তা করতে পেরেছেন এক কালোত্তীর্ণ প্রতিভাবলে। অনেকে ইউরোপের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগকে বড় করে দেখান। কিন্তু বিষয়টি এত সরলরৈখিক নয়। প্রথম জীবনে বিলেতি সভ্যতার প্রতি কিছু মোহমুগ্ধতা থাকলেও পরবর্তীতে তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ এর সবচেয়ে বড় দলিল। তিনি উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক শ্রেষ্ঠত্বের বোধকে অগ্রাহ্য করে প্রাচ্যের জ্ঞানতত্ত্বকে পশ্চিমের সামনে তুলে ধরেছেন। পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের পরিবর্তে উপস্থিত করেছেন প্রাচ্যের মানবিক ডিসকোর্স। আর এভাবেই তিনি গড়ে তুলেছেন উপনিবেশবাদবিরোধী মতাদর্শিক বৌদ্ধিক প্রতিরোধ।

 

তিন.

রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য চর্চার বাইরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শিক্ষা বিস্তারে। তার শিক্ষা ভাবনায় কিছু স্ববিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং একই সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় তপোবন আশ্রিত জীবনবোধের প্রতি মোহমুগ্ধতা এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতাটি হচ্ছে উপনিবেশিক কাঠামোর বাইরে ভিন্নতর শিক্ষাভাবনা, যা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।

 রবীন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি কখনো আগ্রহ অনুভব করেন নি। উপনিবেশিক শাসকদের গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার কাছে মনে হয়েছে পাগলাগারদ বা হাসপাতাল। এজন্য তিনি ভারতীয়দের ইংরেজি লেকচারের ফনোগ্রাফ, বিলেতি অধ্যাপকের শিকল বাঁধা দাঁড়ের পাখি না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন-

“বিদ্যালয়ের ঘর বানাইলে তাহা বোর্ডিং ইস্কুল বলিতে যে ছবি মনে জাগিয়া উঠে তাহা মনোহর নহে- তাহা বারিক, পাগলাগারদ, হাসপাতাল বা জেলেরই একই গোষ্ঠীভুক্ত।”

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে নিজস্ব সংস্কৃতির পাটাতনে স্থাপন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শেকড় বিচ্ছিন্ন আরোপিত শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহতা সম্বন্ধে তার মন্তব্য যুক্তিযুক্ত-

আর তা যদি একান্তই অসম্ভব বলে গণ্য করি, তবে বিশ্ববিদ্যালয় চিরদিন বিলাতের আমদানী করা টবের গাছ হয়ে থাকবে, টব মূল্যবান হতে পারে, অলঙ্কৃত হতে পারে, কিন্তু গাছকে সে চিরদিন পৃথক করে রাখবে ভারতবর্ষের মাটি থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সখের জিনিস হবে, প্রাণের জিনিস হবে না।

ভারতবর্ষে যখন লর্ড মেকলের চুইয়ে পড়া শিক্ষানীতি সার্বজনীন শিক্ষার বিপরীতে একটি ব্রিটিশ অনুগত গোষ্ঠী তৈরির দিকে অগ্রসর হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তারের লক্ষে কৃষকদের তার জমিদারিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

আমার জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য হল শিক্ষার আলোক বিস্তার... আমাদের চাষী সাধারণকে অজ্ঞতার হাত থেকে মুক্তি দেওয়া

তার এই বক্তব্য রেঁনেসাসের চেতনা থেকে আরো এগিয়ে প্রগতিশীলার পথকে প্রশস্ত করে। স্পষ্ট বোঝা যায় তার শিক্ষাচিন্তা শ্রেণি বিশেষের জন্য নয়, এর লক্ষ্য সার্বজনিন, গোটা জাতি। তার এই ভাবনা এদেশের মার্কসবাদী চিন্তকদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশবাদ বিরোধী শিক্ষাচিন্তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে ‘তোতাকাহিনী’ শীর্ষক প্যারালালে। এই কাহিনীতে দেখা যায়, রাজা মন্ত্রীকে একটা পাখিকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পাখিটা একে তো মূর্খ, কায়দা-কানুন জানে না, উপরন্তু রাজার বাজারে লোকসান ঘটায়। ফলে পণ্ডিতরা শুধু কলম নয়, সড়কি দিয়ে পাখিটিকে শিক্ষা দিতে থাকে এবং এতে তার মৃত্যু হয়। এই কাহিনীতে ‘বাজার’ এবং ‘সড়কি’ শব্দ দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রকৃতপক্ষে এই ‘বাজার’ হলো উপনিবেশের বাজার, যা ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী নষ্ট হতে দিতে পারে না, আর সামরিকায়নের মাধ্যমে হলেও পাখি নামক শিক্ষার্থী বা প্রজাকে সে বশে রাখতে চায়। এজন্যই রাজার নির্দেশে কারাগার সদৃশ শিক্ষালয়ে চলে পাখির উপর নিবিড় ঔপনিবেশিক শিক্ষাদান কর্মসূচি। এই প্রেক্ষাপটে আধিপত্যকামী ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রকল্পের বিপরীতে উত্তর উপনিবেশিক শিক্ষাদর্শন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় জবরদস্তি ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চালু করা। রবীন্দ্রনাথ উচ্চকণ্ঠে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন- “বিদ্যা বিস্তারের কথাটা যখন ঠিকমত মন দিয়া দেখি, তখনকার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখিতে পাই যে, তার বাহনটা ইংরেজি।” রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসন আমলেই ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন-

ইংরেজি কাজের ভাষা, ভাবের ভাষা নয়। প্রচলিত শিক্ষায় ইংরেজি ভাষায় ভাবের চর্চা হয় না, ভাবের সঙ্গে ভাষার মিল হয় না বলেই যত সমস্যা। কারণ শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য সাধনই প্রধান বিষয়।

ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিশেষ গোষ্ঠী তৈরির যে উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের, তার বিপরীতে সর্বজনীন শিক্ষার আদর্শকে দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন-

দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার উপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে এবং সেই শিক্ষার গভীরতা স্থায়ীত্বের উপর যদি স্থায়ীত্ব নির্ভর করে, তবে মাতৃভাষা ছাড়া যে আর কোনও গতি নাই।

সমস্ত জাতিকে শিক্ষার আলোকবর্তিকায় আলোকিত করার জন্য শিক্ষায় মাতৃদুগ্ধরূপী মাতৃভাষা চালুর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি বলেন-

যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির ক্রিয়ার সহিত তাহার যোগ সাধন হয়।

তাই তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে বিলেতি তলোয়ারের খাপের মধ্যে দেশি খাঁড়া ভরিবার ব্যায়াম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাভাষা যথেষ্ট নয়- এ সম্পর্কিত ধারণা বহুদিন থেকে চলে আসছে। রবীন্দ্রনাথ এই অজুহাত বাদ দিয়ে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনার আহ্বান জানান। বিজ্ঞান শিক্ষাকেও সর্বজনীন করতে হলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা জরুরি। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ-

বিজ্ঞান যাহাতে দেশের সর্বসাধারণের নিকট সুগম হয়, সে উপায় অবলম্বন করিতে হইলে একেবারে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার গোড়াপত্তন করিয়া দিতে হয়... ঘরে বাহিরে চারিদিকে বিজ্ঞানের আলোক পরিব্যাপ্ত করিয়া দিলে বিশেষভাবে বিজ্ঞানের চর্চা এদেশে স্থায়ীরূপে বর্ধিত হইতে পারিবে।

উপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ; তার এই সংগ্রাম ছিল বৌদ্ধিক, মতাদর্শিক ও রাচনিক। জীবন-জীবিকাভিত্তিক সর্বজনীন যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা তিনি বলেছেন, তাতে তাঁর জনমুখী চেতনার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বোঝা যায়- আমি তোমাদের লোকএই ঘোষণা তার বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এই বোধ শ্রেণিচেতনার বিচারেও গ্রহণযোগ্য। ভাববাদী ও রোমান্টিক জমিদার কবি তার শিক্ষাচিন্তার ক্ষেত্রে অনেক বেশি মানবিক চেতনায় সিক্ত, গণমুখী ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মাতৃভাষায় শিক্ষার যে বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন, আজকের দিনে স্বশাসনের সময়কালে এসেও একই দাবি অব্যাহত রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার এখনও সুদূরপরাহত। উপনিবেশ-উত্তর এই ঔপনিবেশিক মানসিকতার বৃত্ত ভাঙ্গতে রবীন্দ্রনাথ আজ শুধু প্রাসঙ্গিকই নন, অপরিহার্যও বটে।

 

তথ্যসূত্র:

(১) সাম্প্রতিক দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ, শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত

(২) বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ, আহমদ রফিক

(৩) সাহিত্যকথা সংস্কৃতিকথা, সনজীদা খাতুন।

 

লেখক: প্রভাষক, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ।