সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অন্নদাতা এক কিশোর কুমারের গল্প
কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক
প্রকাশিত : ০৯:৩৩ পিএম, ১৪ জুলাই ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:৪৪ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রবিবার
বিনা বেতনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা এবং এক টাকায় খাবার, চিকিৎসা, আইনি সহায়তা! শুনলেই আবাক লাগার কথা। এ যুগে এসব কল্পনাতীত ব্যাপার। এক টাকায় মিলছে দুপুরের খাবার! অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন ৪০০ বছর আগের শায়েস্তা খাঁ’র আমলের গল্প বলছি বুঝি! নাহ, হাল আমলের ঘটনা এটি। শুনতে অবাক লাগলেও এমন একটি মানবিক কাজ সম্ভব করেছেন কিশোর কুমার দাশ। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর পল্লবীতে গড়ে তোলেন সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’।
টাকার অভাবে এসএসসি’র পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় কিশোর কুমার দাশের। টানা ২ বছর নিয়মিত টিউশনির টাকা জমিয়ে আবার নিয়মিত পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। এরপর চুয়েট থেকে সিএসই বিষয়ে পড়াশোনা করে তৎকালীন ওয়ারিদ (বর্তমানে এয়ারটেল) টেলিকমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি বিদেশ পাড়ি দেন। বিগত পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর লিমা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি। একটি বহুজাতিক কোম্পানির কমার্শিয়াল ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন সেখানে। মাঝে মাঝে সময় নিয়ে দেশে আসেন এবং নিজস্ব অর্থায়নই চালাচ্ছেন ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’।
‘অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছি। নিজেই ছিলাম মন্দিরের সামনে ক্ষুধার লাইনে। তখন চিন্তা ছিল, আমিও একদিন ফিরিয়ে দিব এই খাবার। সেই চিন্তা থেকে মূলত: এই কর্মসূচি চালু করি। এছাড়া আমার বিয়ের পর সংসার টিকেনি। আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। এমনকি জীবন নাশের পরিকল্পনাও মাথায় ছিল। তখন মাথায় এলো এমন কিছু করা উচিত যাতে সেই আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। আরেকটা কারণ ছিল খুবই দরিদ্র শিশুদের স্কুলে টানার জন্য, ধরে রাখার জন্য খাবার ১ টাকায় বিতরণ।’ অসহায় মানুষের বন্ধু এই ত্যাগী মানুষটির সঙ্গে সম্প্রতি খোলামেলা আলোচনা করেছেন ইটিভি অনলাইনের জুনিয়ার সাব-এডিটর কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক। পাঠকদের জন্য আলোচনার বিশেষ অংশগুলো তুলে ধরা হলো।
ইটিভি অনলাইন : বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কাজের পরিধি সম্পর্কে কিছু বলুন।
কিশোর কুমার দাশ : এটি একটি শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পড়ব, খেলবো , শিখবো এই শ্লোগানে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হয় এখানে। সারা দেশে এর ৮টি শাখা রয়েছে, যেখানে ৭৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। প্রতিদিন অন্তত ১২০ জনের মতো শিশু নিয়মিত এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে থাকে। ৬ থেকে ৮ জন বেতনভুক্ত শিক্ষক নিয়োজিত রয়েছেন। রাজবাড়িতে একটি এতিমখানা, রামুতে আদিবাসীদের এতিমখানা ও একটি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। এটি মূলত: একটি সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১ টাকায় চিকিৎসা ও আইনি সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে।
ইটিভি অনলাইন : একটাকায় প্রতিদিন কতজন নিরন্ন মানুষকে খাবার দেন। কোন কোন জেলায় এর কার্যক্রম চলছে?
কিশোর কুমার দাশ : সুবিধাবঞ্চিত পথ শিশুদের মাঝে এক টাকায় খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি নিয়েছে বিদ্যানন্দ। রাজধানী ঢাকাসহ ৬টি জেলায় সুবিধাবঞ্চিত ১২ বছরের নিচে শিশু ও ৬০ বছর কিংবা তদোর্ধ্ব বৃদ্ধ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মাঝে ৩৬৫ দিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যেমন - মিরপুর, গাবতলী, কমলাপুর , টঙ্গিতে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হয়ে থাকে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকগণ ঢাকায় প্রতিদিন ৩০০ পথশিশুকে খাবার বিরতণ করে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী,রামুতে এক টাকায় খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়ে থাকে।
ইটিভি অনলাইন : কখন থেকে শুরু করলেন? এক টাকায় আহার দিতে গিয়ে আপনি কোনো প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা , হলে সেটা কিভাবে সমাধান করেছেন?
কিশোর কুমার দাশ : আমরা ২০১৬ সালের মে মাস থেকে আহার দেওয়া শুরু করি। প্রথম প্রথম দাতা ও গ্রহীতাদের বিশ্বাস ও যোগ্যতার অভাব ছিল। অনেকে এটাকে মিশনারিজ প্রতিষ্ঠান মনে করে বাধা প্রদান করেছে। অনেকে বলেছেন - এই কর্মসূচি ধর্মান্তরিত করতে কাজ করছে। এছাড়া হাসি ঠাট্টা করে বিদ্রুপ করত অনেকে। স্থানীয় রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পরে অবশ্য সেটা কাটিয়ে উঠতে সম্ভব হয়েছি।
ইটিভি অনলাইন : আহারের টাকার উৎস কী? কারা অর্থের যোগান দিচ্ছেন?
কিশোর কুমার দাশ : সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ারদের টাকায় মূলত এই কর্মসূচি চলে। এছাড়া আমাদের স্বেচ্ছাসেবরা সেচ্ছায় অর্থ প্রদান করেন সামর্থ্য অনুযায়ী। কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের মাঝে মাঝে সহযোগিতা করে থাকেন। যেমন - এলিট ফরস, প্রাণ, কাজী ফার্ম, ইউনিলিভার ইত্যাদি।
ইটিভি অনলাইন : এ পর্যন্ত কত প্যাকেট খাবার সরবরাহ করেছেন?
কিশোর কুমার দাশ : গত ১ বছরে ৬ লাখের বেশি শিশুকে খাবার প্রদান করা হয়েছে।
ইটিভি অনলাইন : আপনার এই কর্মসূচি পরিচালনায় মাসিক কিংবা বাৎসরিক কত টাকা প্রয়োজন? এই টাকার স্বচ্ছ হিসাব কীভাবে নিশ্চিত করেন?
কিশোর কুমার দাশ : প্রতি মাসে প্রায় ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। বাৎসরিক ২ কোটি টাকার উপরে প্রয়োজন। আমি দেশের বাহিরে থেকে সারভিল্যান্স ক্যামেরার মাধ্যমে সবকিছু মনিটরিং করি। এছাড়া টাকা পয়সার স্বচ্ছতার জন্য দেশের বড় অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করানো হয়।
ইটিভি অনলাইন : সমাজকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
কিশোর কুমার দাশ : দেখুন, আসলে চ্যারিটি করে দেশ পরিবর্তন করা যায় না। তবুও আমি পারিপার্শ্বিক মানুষের প্রতি আমার দায়িত্বটুকু পালন করছি মাত্র। আমি একা নই, এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শত শত তরুণ অবদান রাখছে। অনেকে হয়ত ভালো অবস্থানের কারণে নিজে এই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে নাই। হয়ত তারা অপেক্ষায় ছিল একটি ফ্লাটফর্মের জন্য। এছাড়া এই কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন সমাজের নানা পেশার মানুষ যেমন- ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক। ফলে আমি এককভাবে কৃতিত্ব দাবি করব না। সবাই চেয়েছে বলে এটি সম্ভব হয়েছে।
ইটিভি অনলাইন : শত শত অভূক্ত শিশুর মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন,আপনার অনুভূতি শুনতে চাই।
কিশোর কুমার দাশ : যেহেতু আমি নিজেই দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে আসছি, ক্ষুধার কষ্ট কেমন আমি জানি? আবেগ এখন আর কাজ করে না। ওরা খেতে পারছে, এটাই বড় কথা। এবং যত দিন পারব দিয়ে যাব।
ইটিভি অনলাইন : বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
কিশোর কুমার দাশ : আগামীতে এটিএম মেশিনের মাধ্যমে নিধারিত স্পট থেকে খাবার গ্রহণ করতে পারবে শিশুরা—এমন পরিকল্পনা রয়েছে।
ইটিভি অনলাইন : কীভাবে দেশের অন্য শাখাগুলো পরিচালনা করছেন?
কিশোর কুমার দাশ : প্রতিটি শাখায় একজন কর্তা ব্যক্তির অধীনে পরিচালনা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতি শাখায় ১ থেকে ৩ জন বেতনভুক্ত কর্মচারী রয়েছেন।
ইটিভি অনলাইন : সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবারের দাম ‘এক টাকা’ কেন বেছে নিলেন?
কিশোর কুমার দাশ : বিষয়টিকে যেন ভিক্ষা হিসেবে না দেখা হয় সেজন্য এক টাকা দিয়ে খাবার কিনতে হয়। এই অর্থ হচ্ছে ১ টাকায় পরিশোধযোগ্য। শুরুতে বিষয়টি নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করেছে, কিন্তু এখন শিশুগুলোর মধ্যে অহংবোধ এসেছে। অনেকে আজ বাকিতে খাবার নিলেও কাল এসে টাকাটা দিয়ে যাচ্ছে। আমি এ জায়গাটায় বদলাতে চেয়েছিলাম, শিশুদের ভেতর ‘ভিক্ষা’ এবং দাতাদের মধ্যে ‘দান’ শব্দটি মোছার জন্য।
ইটিভি অনলাইন : এক টাকার খাবারের মেন্যু কী ?
কিশোর কুমার দাশ : খাবারের মেন্যুতে বেশিরভাগ সময় সবজি-ভাত থাকে। তবে কেউ অনুদান দিলে মাংস-পোলাওয়ের মতো ভালো খাবার জোটে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভাগ্যে। আর এই খাবারগুলো রান্না করে থাকেন বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা।
ইটিভি অনলাইন : আমরা জেনেছি দেশের বাহিরেও এই কর্মসূচি চালু করেছেন। পেরুর স্থানীয় জনগণ এটিকে কীভাবে দেখছে?
কিশোর কুমার দাশ : পেরু’র রাজধানী লিমাতেও এক টাকায় আহার প্রজেক্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। পেরুতে আমার একটি হোটেল ব্যবসা আছে। সেখান থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে এটি পরিচালনা করা হয়। রান্নার আয়োজন হয় হোটেলের রান্নাঘরে। রান্নায় অংশ নেন হোটেলের অতিথি হিসেবে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা।
ইটিভি অনলাইন : এক টাকায় আহার, এটাকে কী কোনো ক্যাম্পেইন নাকি ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই?
কিশোর কুমার দাশ : আসলে আমি নিজেই ক্ষুধার সাথে লড়েছি, তাই আমি জানি কষ্ট কি? আর তাই এটিকে ক্যাম্পেইন ও বলা যেতে পারে। আমি একা কখনো ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করতে পারব না। আমি আমার সীমাবদ্ধতা থেকে করছি, সমাজের আর বাকি সব মানুষকেও আহবান জানাচ্ছি।
কিশোর কুমার স্বপ্ন দেখেন, তার এই প্রোজেক্ট একদিন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। অভুক্ত থাকবে না পৃথিবীর কোনো শিশুই। কারণ, ছোটবেলায় খাবারের আশায় মন্দিরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তিনি। বোঝেন ক্ষুর্ধাত মানুষের বেদনা। তাই পাশে দাঁড়াতে চান সুবিধাবঞ্চিত মানুষের।
কেআই/ডব্লিউএন