ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদ

তুমি আছ হৃদয়ের ক্যানভাসে, রবে চিরদিন

প্রকাশিত : ০৯:৩৪ এএম, ১৯ জুলাই ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৭:৫৭ পিএম, ২০ জুলাই ২০১৭ বৃহস্পতিবার

তিনি কথার জাদুকর, গল্পের রাজপুত্র। না ফেরার দেশে চলে গিয়েও তিনি আছেন। আজও তার স্থান বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়, রবে চিরদিন। তিনি আর কেউ নন- কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

পাঁচ বছর আগে শ্রাবণের এই দিনে পাড়ি জমান হুমায়ূন আহমেদ। আজ বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র হুমায়ূনের প্রয়াণ দিবস। নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের আজকের দিনে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরদিন তার মরদেহ সমাহিত করা হয় গাজীপুরের নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়।

আজ লেখকের মৃত্যু দিবসে তার সমাধিক্ষেত্র ভরে উঠেছে  ফুলে ফুলে। ভক্ত ও অনুরাগীরা ফুলেল শুভেচ্ছা ও দোয়া কামনার মাধ্যমে লেখকের প্রতি ভালোবাসা জানাচ্ছেন।

আত্মজৈবনিক গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন- ‘কল্পনায় দেখছি নুহাশ পল্লীর সবুজের মধ্যে শ্বেতপাথরের কবর, তার গায়ে লেখা- ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।’ সে কথাগুলো কাচের এপিটাফ করে তার সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন নিজের নকশায় সাজিয়েছেন স্বামীর কবর।

সেখানে আজ ভোরে শ্রদ্ধা জানান শাওন ও তার দুই শিশুপুত্র নিনিদ ও নিষাদ। এরপর হাজারও হুমায়ূন ভক্ত নুহাশ পল্লীর লিচুতলায় বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো শুরু করে প্রিয় লেখককে। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নুহাশ পলীর পার্শবর্তী এতিমখানার অনাথ শিশুদের জন্য খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে  হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের খাবার।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম কাজল। বাবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি সবার বড়। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পর পরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- শঙ্খনীল কারাগার, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প, কবি, লীলাবতী, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, মধ্যাহ্ন, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনী দ্বীপ, নক্ষত্রের রাত প্রভৃতি।

তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেঁটুপুত্র কমলা। টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তার প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। তার হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে।

হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তি হয়ে আছেন বাংলাদেশের টিভি নাটকের জগতেও। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। উনিশশ’ আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তার সৃষ্টি করা চরিত্রদের বিপদে রাস্তায় নেমে আসত মানুষ।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেয়ার জন্যে লেখকের বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন দর্শকরা। দর্শকদের মিছিল বের হয়েছিল। কথা শোনেননি বাকের ভাইয়ের স্রষ্টা হুমায়ূন। বড্ড বেরসিক (!) ছিলেন। সমাজের দৈনতাকে বাস্তবতায় দেখাতে বাকের ভাইকে ফাঁসির কাষ্ঠে চড়িয়েছিলেন তিনি।

তার অন্যতম নাটকগুলোর মধ্যে এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, তারা তিনজন, আমরা তিনজন, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম, জল তরঙ্গ, ইবলিশ উল্লেখযোগ্য।

একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় এক নাম। হুমায়ূন আহমেদে মৃত্যতে শোক প্রকাশ করে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সব গুণী মানুষ একে একে চলে যাচ্ছে। হুমায়ূনকে হারিয়ে অনুভব করছি, আপনজন হারানোর বেদনা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের জন্য আমরা যারা কাজ করে আসছি, হুমায়ূন আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মানুষকে হলমুখী করেছিলেন।’

মূলত তার চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হয় নব্বই দশকের প্রথম দিকে। এই আগ্রহ আর সীমাহীন স্বপ্ন ছিল জীবনের শেষভাগেও। মোট ৮টি ছবি নির্মাণ করে গেছেন তিনি। ছবিগুলো হলো আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, আমার আছে জল আর ঘেটুপুত্র কমলা।

হুমায়ূন আহমেদ চিরদিন সম্মানিত হয়ে থাকবেন আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, ডলি জহুর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আলী জাকের, জাহিদ হাসান, মেহের আফরোজ শাওন, স্বাধীন খসরু, ডা. এজাজ, মাহফুজ আহমেদ, কুদ্দুস বয়াতি, বারী সিদ্দিকী, ফারুক আহমেদ, বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার, প্রাণ রায়, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শামীমা নাজনীনের মতো অসংখ্য নন্দিত শিল্পীদের কারও কারও উত্থান ও কারও বা অনিন্দ্য বিকাশের কারিগর হিসেবে।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ‘একুশে পদক’, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

//এআর