ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

আট বছর তদারকি

২৯ হাজার প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ভোক্তা অধিদফতরের

ইয়াসির আরাফাত রিপন

প্রকাশিত : ০৩:০৬ পিএম, ২১ জুলাই ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৫৫ এএম, ২২ জুলাই ২০১৭ শনিবার

পণ্যে ভেজাল, অ-স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি, মূল্যে কারসাজি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, ওজন কম দেয়াসহ বিভিন্ন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটি গত আট বছরে বাজার তদারকির মাধ্যমে পণ্যে ভেজাল, মূল্য কারসাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৯ হাজার ৫৬২টি প্রতিষ্ঠানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ২০ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ৪শ’ টাকা। বাজারে যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে দ্রুত তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে ভোক্তা অধিদফতর। এ কারণে ভোক্তাদের কাছ থেকে সাড়াও পাচ্ছে। শুরুর দিকে অভিযোগ কম পেলেও দিন দিন সেই সংখ্যা বাড়ছে। সঠিক অভিযোগদাতাকে আদায়কৃত জরিমানার এক চতুর্থাংশ দেয়ায় অনেকেই ব্যবসায়ীদের অসাধু তৎপরতার বিরুদ্ধে অধিদফতরে অভিযোগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে শুরু করেছে অধিদফতর।  

অধিদফতর সুত্র জানায়, পণ্যের মূল্য, ভেজাল ও ওজনে কারচুপিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তর সোচ্চার রয়েছে। প্রতিদিন দেশব্যাপী ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সারাদেশে ৪৫ টি দফতরের মাধ্যমে কার‌্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণ ভোক্তারা কোনো অনিয়ম পেয়ে এসব দফতরে অভিযোগ করলে, সঙ্গে সঙ্গে দায়ী ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্মকর্তারা বলছেন, ভোক্তারা তাদের নিজ জায়গা থেকে সচেতন হচ্ছেন। তাই তাদের কাছে কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা আদায় করলে বা কোনোভাবে ঠকালে তারা অধিদফতরে অভিযোগ করছে। এর সুফলও তারা পাচ্ছে। এ ছাড়া ভোক্তারা যাতে তাদের আইন ও অধিকারের বিষয়ে জানতে পারেন এজন্য অধিদফতর এরইমধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করছে।

সঠিক অভিযোগদাতা পাচ্ছেন জরিমানার ২৫ ভাগ

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, অনিয়মের ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রদানকারীকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থেকে জরিমানার টাকার এক চতুর্থাংশ দেয়া হয়। অভিযোগকারী ব্যাক্তির অভিযোগ সঠিক হলে অধিদফতর দায়ী প্রতিষ্ঠানকে যে পরিমাণ টাকা জরিমানা করে তার ২৫ শতাংশ পুরস্কার হিসেবে দিয়ে থাকে। সবশেষ তথ্যানুযায়ী গত ৮ বছরে ১৮৬২ জন সঠিক অভিযোগকারীকে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ দিয়েছে ভোক্তা অধিদফতর। সেই পুরস্কারের পরিমাণ ২২লাখ ২৩ হাজার ৬৩৭ টাকা। জরিমানার অবশিষ্ট ২০ কোটি ২৫ লাখ ১১ হাজার ৭৬২ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিদফতরে অভিযোগকারী আহমেদ হোসেন মোল্লা কামাল ইটিভি অনলাইনকে জানান, তিনি গত ১৪ জুন রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত একটি নামিদামী সুপারশপের আউটলেটে যান ইফতার কিনতে।  নামের অদ্যাক্ষর ‘আ’ দিয়ে শুরু ওই সুপারশপের সরবরাহ করা ইফতার সামগ্রীতে তিনি তেলাপোকা দেখতে পান। পরে সুপারশপের যেখানে ইফতার তৈরি হয় ওই কক্ষে উকি দিয়ে দেখেন পরিবেশ খুবই নোংরা। তিনি ১৫ জুন ভোক্তা অধিদফতরে অভিযোগ করেন। অভিযোগ তদন্ত শেষে ওই রেস্টুরেন্টকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। যার ২৫ শতাংশ (৬ হাজার ২৫০ টাকা) গত বুধবার আহমেদ হোসেনকে পুরস্কার হিসেবে বুঝিয়ে দেয় ভোক্তা অধিদফতর। তবে, উত্তরার ওই সুপারশপের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া না দেয়ায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে

জানা গেছে, ভোক্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়ায়  ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগের সংখ্যাও সম্প্রতি বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক অভিযোগ বৃদ্ধি ও অভিযোগ নিষ্পত্তিকে একটি ধারাবাহিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত) মো. মাসুম আরেফিন। তিনি ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ২০১৫ সালে অধিদফতরে অভিযোগ এসেছিল মাত্র ২২৫টি। পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৬২২টিতে উন্নীত হয়। আর চলতি বছর প্রথম দুই মাসেই অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৮২টিতে। জুন পর্যন্ত সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৯৬টিতে।

অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুম আরেফিন বলেন, মানুষ এখন অনেক সচেতন, টাকায় কেনা পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম দেখলে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। ফলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে দিন দিন অভিযোগের সংখ্যাও বাড়ছে।

যে সব অপরাধের কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয় তার মধ্যে রয়েছে-উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ না থাকা, মূল্য তালিকা না থাকা, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম রাখা, ওজন কম দেয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি ও বিক্রি, আসল প্যাকেটে ভেজাল পণ্য সরবরাহ করা ইত্যাদি। উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখা না থাকা, মূল্যের তালিকা না থাকা, বেশি দামে পণ্য বিক্রির দায়ে ১১ হাজার ৪৯৪ টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৬ কোটি টাকা জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিদফতর।

ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা এবং প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করায় ১১ হাজার ৭৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ওজনে, বাটখারা বা পরিমাপপক যন্ত্র, দৈর্ঘ্য পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপির অভিযোগে ১ হাজার ৫৬৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।

এছাড়া পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয় করা, অবহেলার কারণে সেবাগ্রহিতার জীবন বিপন্ন করা, স্বাস্থ্যহানি ঘটানোর অভিযোগে ৫ হাজার ৫৯টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে ভোক্তা অধিদফতর।

৭ হাজার ২২৩ অভিযোগ নিষ্পত্তি

ভোক্তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এসব ব্যবস্থা নেয়ার পরও অধিদফতরে যথেষ্ট অভিযোগ আসছে না। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল কার‌্যক্রম শুরু থেকে ২০১৭ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত অধিদফতরে মোট অভিযোগ আসে ৭ হাজার ৫৫৯টি। অভিযোগের ভিত্তিতে বাজার তদারকি করে সত্যতা প্রমাণ হওয়ায় অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় ৭ হাজার ২২৩টি। এর মধ্যে তদন্তাধীন রয়েছে ৩৩৬টি। এতসবের পরও অভিযোগ প্রত্যাশিত মাত্রায় আসছে না। এমনকি সঠিক অভিযোগদাতারা জরিমানার ২৫ ভাগ পুরস্কৃত হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই অভিযোগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর পেছনে প্রচারের অভাবকেই দায়ী করছেন কেউ কেউ। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, জরিমানার ২৫ ভাগ সঠিক অভিযোগকারী পাচ্ছেন এ বিষয়টি অনেকেই জানে না। সেই সঙ্গে অভিযোগের ৭ দিনের মধ্যেই ভোক্তা অধিদফতর অভিযোগ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে, এ বিষয়টিও অনেকে জানেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, শুধু অধিদফতরের মাধ্যমেই ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা যাবে না। এ জন্য চাই সবার সচেতনতা। এজন্য এবার ৮০টি গণশুনানি করেছি যা গত বছরের ছিল ১৪টি। ৩১৯টি সেমিনার করেছি, জেলাগুলোতে প্রতিনিয়ত সভা চলে লোকজনকে সচেতনতা করতে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, জনগণ সচেতন হয়ে সঠিক অভিযোগ দিলে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পিছ পা হবে না ভোক্তা অধিদফতর।

//এআর