ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

জনপ্রতিনিদের সুদৃষ্টির অভাবে সীতাকুণ্ডে জলাবদ্ধতা

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৭:৫৪ পিএম, ৯ আগস্ট ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৮:০০ পিএম, ৯ আগস্ট ২০১৭ বুধবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জলাবদ্ধতা নতুন কোনো সমস্যা নয়। এটি দীর্ঘ পুরোনো সমস্যা। অতীতে এ সমস্যা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন সময়ে গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সেমিনার হয়েছে। স্থানীয় এমপির উপস্থিতিতে মেয়র ও প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাদের নিজ নিজ এলাকার জলাবদ্ধতার কারণ এসব সভায় তুলে ধরেছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে জলবদ্ধতার সমস্যা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অতীতের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা ভোটে জয় লাভ করেছেন। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তারা কেউই তাদের কথা রাখেননি। জনপ্রতিনিধিদের চরম উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে সীতাকুণ্ডবাসীর জলাবদ্ধতার ‘গজব’ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়ার কোনো আলামত নেই।

দীর্ঘ দিন ধরে খাল সংস্কার ও পুনঃখনন না করা, সাগরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখের স্লুইসগেট বা জলকপাটগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো অকেজো হয়ে থাকা, জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রেলসড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলোতে পানি চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা (ব্রিজ-কালভার্ট) না থাকায় সীতাকুণ্ডে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। পাহাড়ী ঢল ও অতিবৃষ্টিতে এবার জলোপদ্রপ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সীতাকুণ্ড পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নের বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় মানুষ মহা অশান্তিতে রয়েছেন। ভেসে গেছে বহু পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। মৎস্য সম্পদ ও কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফসলের মাঠ সাগরের রূপ ধারণ করেছে। গ্রামীণ সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে নৌকা। জলাবন্ধতার কারণে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। আমন বীজতলা ও শাক-সবজির বিশাল ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে জনপ্রতিনিধিদের ছিমছাম পোশাক পরে বন্যাকবলিত এলাকায় হাটুজল মাড়িয়ে জনদুর্ভোগ পরিদর্শন করতে দেখা গেছে। ভাগ্যিস! তাদের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়নি ‘বাহ্ কী চমৎকার দৃশ্য!’

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সীতাকুণ্ড পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মুঠোফোনে বলেন, ‘‘খাল-সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ দিতে উপরমহলে তিনবছর ধরে লেখালেখি করে কোনো সাড়া পাচ্ছি না।’’

তাহলে ধরে নিতে হবে খাল-সংস্কার করার জন্য অর্থযোগান দেয়ার সাধ্য বর্তমান সরকারের নেই? অর্থাভাবে শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের খাল পুনঃখনন কিংবা সংস্কার করা যাচ্ছে না-এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? তাছাড়া সীতাকুণ্ডের মতো একটি শিল্পসমৃদ্ধ এলাকায় খালসংস্কারের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাজটা কী? পানি উন্নয়ন বোর্ড পারছে না বলে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা যদি এলাকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হন তাহলে যেকোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রশাসন চাইলে এলজিইডি’র মাধ্যমেও খাল-ছরা সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে।

এদিকে সীতাকুণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক শিল্পপতি আছেন। সীতাকুণ্ডের প্রতি তাদের কিছু দায়দায়িত্ব আছে। তাদের আছে সিএসআর প্রোগ্রাম। স্থানীয় এমপি ও উপজেলা প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা যদি খাল পুনঃখনন ও সংস্কারের ব্যাপারে শিল্পকারখানার মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা কামনা করেন অবশ্যই তাঁরা এগিয়ে আসবেন। প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানেরাও নিজ নিজ এলাকার খাল-ছরাগুলো শুষ্ক মৌসুমে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সংস্কারের জন্যে ছাত্র ও যুবসমাজকে কাজে লাগাতে পারেন। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী নিজেদের স্বার্থে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল-ছরা সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করবে।

এদিকে, ভূমি রেজিস্ট্রেশন করের (১%) বিপরীতে উপজেলা প্রশাসন উন্নয়নখাতে খরচ করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের মিউচ্যুয়াল ফান্ডে লাখ লাখ টাকা দেয়া হলেও জনস্বার্থে এটাকা ব্যয় করার রেকর্ড নেই। এছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানেরা টিআর, কাবিটা, এলজিএসপিসহ বিভিন্ন খাত থেকে বছরে যে এক/দেড়কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ পান তা থেকে ২৫% টাকাও যদি খাল-ছরার সংস্কারে ব্যয় করা হতো তাহলে এলাকা জলমগ্ন হয়ে জনগণকে এ দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।  

বশরতনগর এলাকার ‘ছোটকুমিরা’ খালে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত রাবার ড্যামটিকে সীতাকুণ্ড পৌরসভা, মুরাদপুর ও সৈয়দপুর ইউনিয়নের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে একদশক আগে চিহ্নিত করা হয়। তারপরও জনপ্রতিনিধিরা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন এ ‘বিষফোঁড়া’ অপসারণের উদ্যোগ নেয়নি বা নিচ্ছে না?

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের ছোটবড় সব খাল ও ছরা দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় এগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বদরখালী খাল, বাঁকখালী খাল, ‘ছোটকুমিরা’ খাল, (সৈয়দপুর ও মুরাদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত) গুলিয়াখালি খাল, বারিয়াখালি খাল, রাজাপুর খাল, গুপ্তাখালি খাল, বাউরিয়া খাল, ছোটকুমিরা খাল, বড়কুমিরা খাল, ফুলছড়ি খাল দিয়ে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি সন্দ্বীপ চ্যানেলে গিয়ে পড়ে। এসব খালের মুখের স্লুইসগেটস বা জলকপাটগুলো দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। এছাড়া এসব খালের বেড়িবাঁধের পশ্চিমাংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিল-খাল ও লোকালয়ের পানি সমুদ্রে পড়তে পারছে না। তাই সমুদ্রের জলসীমানা পর্যন্ত খালগুলোর ব্যাপক সংস্কারের পাশাপাশি জলকপাটগুলোরও আমূল পরিবর্তন জরুরি।

পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তো চট্টগ্রামেরই সন্তান। তাঁর সাথে যোগাযোগ ও তদবির করে খাল-ছরা ও জলকপাটগুলো সংস্কারের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ আদায় করতে না পারার ব্যর্থতা কার? বিশেষ বরাদ্দ দূরের কথা, জাতীয় কোষাগারে উল্লেখযোগ্য অর্থযোগানদাতা সীতাকুণ্ডের ন্যায্য হিস্যা আদায় করার দায়িত্ব যাদের তাঁরা করছেনটা কী? সর্বক্ষেত্রে আর কতকাল সীতাকুণ্ডবাসী শোষণ-বঞ্চনার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হবে? আর কতদিন এখানকার হতভাগ্য জনগণ বিশেষ করে কৃষকেরা জলাবদ্ধতা সমস্যায় জর্জরিত হবে? আগামী বর্ষার আগে কী এর কোনো সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা আছে? এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের তারা কি তৎপর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আদৌ অনুভব করেন?