যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বের স্বার্থে ছাত্র সংসদ সচল করা জরুরি
মোহাম্মদ ইউসুফ
প্রকাশিত : ০৫:০১ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৩৬ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৭ শনিবার
ঢাকসু নির্বাচনের দাবিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জেগে উঠেছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে ছাত্রশিক্ষক মল্লযুদ্ধও হয়ে গেছে। গত ৯ আগস্ট শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে ‘দুই চাক্কার মিছিল’বের করে। এরপরদিন ১০ আগস্ট একই দাবিতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ঢাবি’র মধুর ক্যান্টিনের সামনে উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দেরিতে হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে; সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তাদের প্রাণের দাবি আদায়ে। শুধু ঢাকসু নয়, দেশের সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালেয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার এখনই সময়। তবে ঢাকসু দিয়ে এর শুরুটা হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
যোগ্য ও মেধাবী ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি হলেও দীর্ঘ দু’যুগ ধরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ‘নেতৃত্ব তৈরির কারখানা’ছাত্র সংসদকে কেন অচল করে রাখা হয়েছে- তা বোধগম্য নয়। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরার পরও এর চাকা সচল হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়, প্রতিভাবান ও যোগ্য-নেতৃত্ব তৈরি, মুক্তবুদ্ধিচর্চা, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও জাতি গঠনমূলক কাজে ছাত্র সংসদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্রসংসদের নেতারা বায়ান্নোর ভাষাআন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। গণতন্ত্রের বিকাশে মুক্তবুদ্ধিচর্চার কোনো বিকল্প নেই। অথচ প্রায় সিকিশতাব্দি ধরে মুক্তবুদ্ধিচর্চার সূতিকাগার ঢাকসু, চাকসু, জাকসু, রাকসু ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, আবাসিক হল ও বিভাগগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ছাত্রসংগঠনের নেতারা চান না ছাত্র সংসদ সচল হোক। কেননা বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের যেসব ছাত্রনেতা আছেন, তারা দলীয় কর্মীদের ভোটে নির্বাচিত নেতা নন; তারা সংগঠনের নেতা হয়েছেন দলীয় হাইকমান্ডের করুণা ও আশীর্বাদে। তারা ভালো করে জানেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি দেয়া হয়, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মন জয় করে ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন না। কেননা, সে-ই ইমেজ তাদের নেই। আর যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠিত হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কর্তৃত্ব ও গুরুত্ব আর থাকবে না। তাই ছাত্রনামধারী নেতারাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চায় না ছাত্র সংসদ সচল করে তাদের একতরফা সুবিধাভোগের পথে ‘বাড়তি ঝামেলা’ তৈরি হোক।
পুঁথিগত জ্ঞানার্জন আর সনদপ্রাপ্তিই কেবল উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে পারে না। পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জনের জন্য আরো অনেককিছু জানা অত্যাবশ্যক। উচ্চশিক্ষার বিষয়টি আরো ব্যাপক। পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসমাজের এসব অনুসঙ্গগুলো পূরণ করতে প্রয়োজন ছাত্র সংসদ। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া তুলে ধরার প্লাটফরম হচ্ছে এ ছাত্র সংসদ। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত নানামুখি সমস্যার মুখোমুখি হয়। অপর্যাপ্ত পরিবহন, লাইব্রেরিতে বইসঙ্কট, হলে সীট না পাওয়া, নিম্নমানের খাবার ইত্যাদি সমস্যা তাদের নিত্যসঙ্গী। অথচ ছাত্র সংসদ না থাকায় এসব সমস্যা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার কোনো মাধ্যম নেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো প্লাটফরমে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত দু’যুগের বেশি সময় ধরে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
অন্যদিকে ছাত্রনামধারী নেতারা ছাত্রদের কল্যাণ করার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ফাও খাওয়াসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে তারা। ছাত্র সংসদ সচল হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনামধারী ‘গুণ্ডা-পাণ্ডারা’ বিতাড়িত হতে বাধ্য হতো। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল সোনালী সেই অতীত আবার পুনরুদ্ধার হতো। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে বিশেষ করে সরকার ও রাজনৈতিক দল পরিচালনায় যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বের যে চরম সঙ্কট চলছে – তা দূর হতো, অতীতে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি সর্বসাধারণের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল- সেই প্রবণতা ফের জেগে উঠতো।
দেশের ‘দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ’ ছাত্র সংসদ সচল না হওয়ার দায় সরকার এড়াতে পারে না। সরকার চাইলে যেকোনো মুহূর্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ সচল করার নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু নানা আশঙ্কার কথা ভেবে শাসকদল চাইছে না ছাত্র সংসদ সচল করে ‘খাল কেটে কুমির আনতে’। অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে, দেশের বেশিভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদে সরকারবিরোধী সংগঠনের অনুসারীরা জয়লাভ করে। ছাত্ররা সচরাচর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি কোনো বিশেষ ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে তা সরকারের জন্যে হয়ে ওঠে অত্যন্ত ভীতিকর ও বিব্রতকর। সরকার সমর্থক ছাত্র সংসদ থাকলে সরকার মোটামুটি স্বস্তিতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে যদি বিরোধীদলের অনুসারি থাকে তাহলে সরকার সর্বদা প্রচ্ছন্ন স্নায়ুচাপের মধ্যে থাকে। অত্যন্ত সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয় সরকারকে। কখন কোন্ ইস্যুতে ছাত্ররা ফুঁসে ওঠে সে ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় সরকারকে।
কিন্তু বর্তমানে ছাত্র সংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি নেতৃত্বহীন। শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতারা একাকার হয়ে সকল সুযোগ-সুবিধে ভোগ করে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি চলে সমানে। সম্মানিত শিক্ষকদের অনেককে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থকে পরিহার করে নিজস্বার্থে তথাকথিত ছাত্রনেতাদের সমীহ করে চলতে দেখা যায়। পদ-পদবী ধরে রাখতে, নতুনপদে আসীন হতে নিজছাত্রের কাছে আত্মসমর্পন করতে অনেক শিক্ষকের মোটেও লজ্জাবোধ হয় না। ক্যাম্পাসে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে যায়। এ অবস্থা আর বেশিদিন চলতে পারে না।
লেখক : প্রধান-সম্পাদক, চাটগাঁর বাণী