পয়সার লোভ স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে
প্রকাশিত : ১০:৫৬ পিএম, ২১ আগস্ট ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ০৩:৫৯ পিএম, ২২ আগস্ট ২০১৭ মঙ্গলবার
একজন অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনের অম্লান একটি নাম নায়ক রাজ রাজ্জাক। কিংবদন্তি এ অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এরপরের দুই দশক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে তাঁর পরিচয় ঘটে। অভিনয় জগতে তার হাতেখড়ি হয় কিশোর বয়সে কলকাতায় মঞ্চ নাটকের মধ্য দিয়ে। তবে জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ে কখনও লোভ স্পর্শ করতে পারেনি তাকে।
লোভ স্পর্শ করতে না পারার বিষয়ে গত বছর এক অনুষ্ঠানে রাজ্জাক নিজেই বলে গেছেন, আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি, না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি।
অনুষ্ঠানে নায়করাজ রাজ্জাক আরও বলেছিলেন, ১৯৬৪ সালে ভেবেছি এফডিসিতে (চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) ঢুকব। এখানে কাদের নামের সেই দারোয়ানের অনেক তাড়া খেয়েছি। ছোটখাটো অনেক অভিনয় করেছি। ৬৬ সালে এসে নায়ক হয়েছি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান এই অভিনেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। কলকাতাতেই তিনি মঞ্চ নাটকে জড়িয়ে পড়েন। পরে ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় ঢাকায় চলে আসেন পরিবারের সঙ্গে। প্রথমদিকে, রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। এরপর থেকে অভিনয় জগতে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। অবশ্য অভিনয় জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে অনেক বেগও পেতে হয়েছে তাঁর।
সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মধ্যেই ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরপর ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
এক সময় জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন রাজ্জাককে, সুচন্দার বিপরীতে। ‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।
সুদর্শন রাজ্জাক সুচন্দার পর শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে। এর মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়।
সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজ্জাক-কবরী জুটির শুরু। এরপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন তারা। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘ঢেউ এর পরে ঢেউ’ এবং স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উপহার দেন এই জুটি।
কবরী তার বইয়ে লিখেছেন, “সিনেমামোদী যারা এসব সিনেমা দেখেছেন, তারাও হয়ে যেতেন রাজ্জাক আর অপরপক্ষ নিজেকে ভাবত কবরী, তাই না?”
রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বেঈমান’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ দিয়ে বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের সূচনাও ঘটান রাজ্জাক।
‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনারকলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি মজনু’, ‘নাতবউ’, ‘মধুমিলন’, ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাজমা’সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের নায়ক রাজ্জাক।
রাজ্জাক অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। ২০১৫ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার।
বদনাম, সৎ ভাই, চাপা ডাঙ্গার বউসহ প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রাজ্জাক। তার মালিকানার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। অভিনয় জীবনের বাইরে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন রাজ্জাক।
আজ সোমবার বিকালে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কিংবদন্তি এ অভিনেতার। রাজ্জাকের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসকরা জানান, হৃদরোগ ছাড়াও তিনি ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতার টালিগঞ্জে জন্ম নেওয়া এ অভিনেতা ছিলেন বাবা মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান। বাবা আকবর হোসেন ও মা মিরারুন্নেসার ডানপিটে সন্তান ছিলেন তিনি। রাজ্জাক স্ত্রী লক্ষ্মী (খায়রুন নেসা), তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং এক মেয়েকে রেখে গেছেন। তার ছেলেরাও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
আরকে/ডব্লিউএন