ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

কিংবদন্তির প্রস্থান : বাস্তবতাকেও মানতে পারছেন না তারকারা

প্রকাশিত : ১২:৩৩ এএম, ২২ আগস্ট ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৫৯ পিএম, ২২ আগস্ট ২০১৭ মঙ্গলবার

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাকের প্রস্থানে হতবাক তারকাজগত। বিশেষ করে তাঁর সমসাময়িক তারকারা প্রকৃতির এই চিরাচরিত নিয়মকেও যেন মেনে নিতে পারছেন না। তারা যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন।

নায়করাজের প্রস্থানে বেদনাসিক্ত হৃদয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন করেছেন চিত্রনায়িকা রোজিনা,অঞ্জনা, সুচন্দা, কবরী মৌসুমি।

রোজিনা

আমাদের গার্ডিয়ান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমাদের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক রাজ্জাক। তার সম্পর্কে বলার মতো সাহস আমার নেই। কিছু ছবিতে তার নায়িকা ও বোন হিসেবে কাজ করেছি। আবার তার পরিচালনায় ‘রাজা মিস্ত্রী’ ও ‘অভিযান’ ছবিতে কাজ করেছি। তিনি অভিনেতা হিসেবে যেমন বড়মাপের, মানুষ হিসেবেও তেমনি অনেক বড়। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতেন। ‘আয়না’ ছবিতে প্রথম রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছি। সেখানে শাবানা ম্যাডাম ছিলেন তার নায়িকা। আমি তো তাদের ছবি দেখে অভিনয়ের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাদের সামনে থেকে দেখা এবং তাদের সঙ্গে অভিনয় করা এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। আমার হাত-পা কাঁপছিল। তখন রাজ্জাক সাহেব আমাকে ছোট বোনের মতোই জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, এটা ব্যাপার না। আমরা তো আছি। ভয় পাচ্ছ কেন? তখন আমার মনে হয়েছিল কতদিনের চেনা তিনি। মানুষকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত শক্তি ছিল তার ভেতরে। ‘অভিযান’ ছবিতে কাজের জন্য প্রায় দেড় মাস নদীপথে ছিলাম। আউটডোরে শুটিংয়ে গেলে সন্ধ্যায় সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে খাওয়াতেন এই মহানায়ক। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে। গত মাসেও তার বাসায় গিয়ে দেখা করে এলাম। প্রিয় এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার কাছে অভিনয় শিখেছি। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক তিনি। আমাদের গার্ডিয়ান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অভিনেতা রাজ্জাক যেমন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, আবার পরিচালক রাজ্জাকের কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। তিনি ধরে ধরে কাজ করিয়েছেন। তার দুই সত্তা দুই রকম। দুদিকেই সমৃদ্ধ তিনি। খুবই দক্ষতা ছিল তার। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের প্রিয় এই মহানায়ককে ভালো রাখেন সেই কামনা করি।

অঞ্জনা

রাজ্জাক ভাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির মহানায়ক। অভিনয় ক্যারিয়ারে ৩৫টির মতো সিনেমায় নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করেছি। ‘অশিক্ষিত’, ‘অভিযান’, ‘বিধাতা’, ‘রাম রহিম জন’, ‘দিদার’, ‘সোনার হরিণ’, ‘সানাই’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র ছিল উল্লেখযোগ্য। শুটিংকালের অনেক স্মৃতিই এখন মনে পড়ে। নতুন হিসেবে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ওই সময় নতুন যারা কাজ করতে এসেছিলেন, সবাইকে উনি ধরে ধরে শিখিয়েছেন। অশিক্ষিত সিনেমায় আমি একক নায়িকা হিসেবে কাজ করেছি। সর্বশেষ তার সঙ্গে আমার লক্ষ্মীকুঞ্জে দেখা হয়েছিল। আমার কুশল নিয়েছেন তিনি। এই প্রিয় মানুষটি আর নেই ভাবতেই খারাপ লাগছে। রাজ্জাক ভাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির মহানায়ক ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তাকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

সুচন্দা

রাজ্জাকের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমি খবরটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছি। কথা বলতে পারছি না। হঠাৎ এমন একটা খবর পাব আশা করিনি। ভীষণ কষ্ট লাগছে। আমার দ্বিতীয় ছবি ‘বেহুলা’তে রাজ্জাকের সাথে প্রথম অভিনয় করা। তখন পাকিস্তান আমল। আমরা জুটি বেঁধে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। সব ছবিই সুপারহিট হয়েছে। পাকিস্তান আমল হওয়ার কারণে আমার আর রাজ্জাকের জুটির কথা এত প্রচার হয়নি। যারা এখন ছবি নিয়ে কথা বলেন তারাও সেগুলোর খবর রাখেননি। পাকিস্তান আমলে কাজ করার কারণে ছবিগুলোর প্রিন্ট সংগ্রহে রাখা হয়নি। তাই ওই ছবিগুলো টেলিভিশনে প্রচারও হয় না। বেহুলা ছবিতে রাজ্জাকের সাথে প্রথম দৃশ্য ছিল আমার সাথে দেখা করা।

সেই দৃশ্যের কথা এখনও চোখে ভাসে। রাজ্জাকের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করতেন। কথা বলতেন নমনীয়ভাবে।

আজকের দিনে ‘বেহুলা’ ছবির একটা দৃশ্যের কথা বেশি মনে পড়ছে। লখিন্দরকে সাপে কাটবে। আমরা এদিকে শুটিং করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ভেতরে বাসরঘর সাজানো আছে সেখানে আমাদেরকে বিশ্রাম নিতে বললেন জহির রায়হান। আমরা বাসরঘরে শুয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে জেগে দেখি আমার শরীরের ওপর বিষধর এক সাপ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তো চিৎকার করে উঠেছিলাম। তখন আমরা দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম ভয়ে। এই কথা বারবার মনে পড়ছে। আমরা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। তার চলে যাওয়ায় কতটা কষ্ট হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না। আমি আমার আপন মানুষকে হারালাম। এমন আপনজনকে হারিয়ে সত্যি আমি বাকরুদ্ধ। তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। তার জন্য অনেক দোয়া। তার পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা।

কবরী

প্রিয় মানুষটির চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘যোগাযোগ’ ছবির মাধ্যমে রাজ্জাকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তারিখটা মনে নেই। শেষ পর্যন্ত ছবিটি আর তৈরি হয়নি। এই ছবির সুবাদেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। তখনও আমি তার সঙ্গে কোনো ছবিতে অভিনয় করিনি।

অল্প পরিচয়ের পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। ‘ময়নামতি’ ছবির পর আমাদের নিয়ে চারদিকে হইচই শুরু হয়ে যায়। এর আগে ও পরে অনেক ছবিতে কাজ করি। ছবিগুলো করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক মিষ্টি মুহূর্ত পেয়েছি। রয়েছে অসংখ্য গল্পও। গল্প আর আড্ডায় আমাদের মধ্যে নিটোল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কোনো ছবির শুটিংয়ে আবার মান-অভিমানের দৃশ্যগুলোতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে মনে হতো না, অভিনয় করছি। মনেই হতো, বাস্তবতার নিরিখে আমরা মান-অভিমানের ব্যাপারগুলো তুলে ধরছি। নিটোল বন্ধুত্বের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। একটা সময় তো তার পরিবারের সঙ্গেও আমার দারুণ একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রিয় মানুষটির চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তার জন্য মন থেকে অনেক অনেক দোয়া করছি। বিধাতা যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।

মৌসুমী

মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য
২০০২ সাল। আমি তখন ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’ ছবিটি বানাব। তার আগে রাজ্জাক ভাই হƒদরোগে আক্রান্ত হন। তখন অবশ্য কিছুটা সুস্থ তিনি। তবে কোনো কাজ করছিলেন না। একটি চরিত্রের জন্য তাকে খুব দরকার ছিল, প্রস্তাব দিতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। সহশিল্পীদের সহযোগিতার ব্যাপারে রাজ্জাক ভাই খুবই আন্তরিক। রাজ্জাক ভাই গুণী শিল্পী। তার সঙ্গে কাজ করা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। সেই সুযোগ আমার হয়েছে। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। তার মতো এত বড় মাপের মানুষকে হারিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প অনেক কিছু হারিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে ভালো রাখুন এই দোয়াই করছি।

প্রসঙ্গত, সোমবার বিকেলে ইহত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক।

ডব্লিউএন