ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

গ্রামজুড়ে দরজা ও তালা ছাড়াই ঘর

প্রকাশিত : ০৭:৪২ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১২:৩২ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার

ঘর আছে দরজা নাই। মানুষ আছে চোর নাই। সম্পদ আছে পাহারা নাই। কথাগুলো শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবতায় ভারতের মহারাষ্ট্রের শনি শিগনাপুর গ্রামের চিত্র এমনই। গ্রামের মানুষ তালা ব্যবহার করে না। তালা তো দূরে থাক, দরজাই নেই! বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট তালা ছাড়া থাকলেও এ গ্রামের অধিবাসীরা থাকেন নিশ্চিন্তে। চোরের কোনো ভয় নেই তাদের মনে। সম্পদ রক্ষায় তাদের একমাত্র ভরসা ভগবান।

শনি শিগনাপুর গ্রামের বাড়িঘর তালাহীন থাকার পেছনে একটি কিংবদন্তি চালু রয়েছে। তারা বলে থাকে, প্রায় ৩০০ বছর আগে প্রবল বৃষ্টির পর বন্যা হয়। বন্যায় পানাশনালা নদী থেকে কালো পাথরের একটি বড় ফলক গ্রামের মধ্যে ভেসে আসে। এক স্থানীয় ১.৫ মিটার লম্বা এ পাথরটিকে লাঠি দ্বারা আঘাত করে। গ্রামবাসী অবাক হয়ে দেখে যে, এ আঘাতে পাথরটি থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

এরপরের রাতে গ্রাম প্রধান স্বপ্নে ভগবান শনিকে দেখতে পেলেন। স্বপ্নে ভগবান শনি দাবি করলেন পাথরটি আসলে তারই মূর্তি। ভগবান শনি গ্রামের প্রধানকে হুকুম দিলেন এই পাথরটি গ্রামে সংরক্ষণ করতে হবে। শনি আরেকটি শর্ত জুড়ে দিলেন যে, এখন থেকে গ্রামের সবকিছু খুঁলেই রাখতে হবে। তিনিই সবকিছু দেখে রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিলেন।

গ্রাম প্রধান স্বপ্নের কথা গ্রামবাসীকে খুঁলে বললেন। তারা এ পাথরটিকে গ্রামের মধ্যবর্তী একটি খোঁলা জায়গায় স্থাপন করল। এরপর তারা তাদের বাড়ির সব দরজা খুঁলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। তারা মনে করল, ভগবান শনি থাকতে তাদের আর এগুলোর দরকার নাই।

৩০০ বছরের পুরনো সে রীতি আজও চলছে। গ্রামের লোকজন কুকুর বা অন্যান্য পশু থেকে রক্ষা পেতে হালকা কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে। এমন অরক্ষিত অবস্থাতেই তারা টাকা-পয়সা, গহনা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রেখে বাইরে চলে যায়। তারা বিশ্বাস তাদের ভগবানই এসব সম্পদ দেখে রাখবেন। শুনতে অবাক লাগলেও তারা পাবলিক টয়লেটেও দরজা লাগায় না। লজ্জা নিবারণের জন্য পাতলা পর্দা ব্যবহার করে মাত্র।

গ্রামবাসী কোথাও গেলে তাদের জিনিসপত্র দেখে রাখার জন্য পাশের বাড়িতে বলেও যায় না। তারা বিশ্বাস করে কেও যদি চুরি করে তাইলে সে অন্ধ হয়ে যাবে। আবার কেও যদি অসততার আশ্রয় নেয় তাইলে সে সাত বছর পরে হলেও বিপদগ্রস্থ হবে। গ্রামবাসী এটাও বিশ্বাস করে যে, কেউ যদি ঘরে কাঠের দরজা লাগায় তাইলে সে কিছুদিনের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়।

দিন দিন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামটিতে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাংক, পুলিশ ফাঁড়ি প্রভৃতি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পুলিশ ফাঁড়ি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কোনোরকম অভিযোগ পায়নি। মজার ব্যাপার হল, গ্রামের রীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পুলিশ ফাঁড়িটিতেও কোনো মূল দরজা নেই। 

সাধারণত ব্যাংকে কড়া নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু সে ধারণাকে বদলে দিয়ে এ গ্রামে ২০১১ সালে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক তাদের একমাত্র তালাবিহীন শাখা চালু করে। গ্রামবাসীর বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা রেখে তারা রিমোট কন্ট্রোল কাঁচের দরজা বসিয়েছে।

শনি শিগনাপুর গ্রামের এমন অদ্ভুত গল্প ছড়িয়ে গেছে সারা ভারতময়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০,০০০ দর্শণার্থী আসে কালো পাথরের মূর্তি দেখতে। যদিও গ্রামটি চোরমুক্ত তবুও এ পর্যন্ত দুজন পর্যটক তাদের টাকা ও অলংকার চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। গ্রামবাসীরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে নিশ্চয় চুরি গ্রামের বাইরে হয়েছে।

দিন বদলের হাওয়ায় এ গ্রামের মানুষের বিশ্বাসেও পরিবর্তন এসেছে। কেউ কেউ তাদের বাড়িতে দরজা লাগাচ্ছেন। এখনো প্রায় সব মানুষই দরজা লাগানোর বিপক্ষে। তবে চাইলেই দরজা লাগানো সম্ভব হয় না; এজন্য নিতে হয় পঞ্চায়েতের অনুমোদন।

আরকে/ডব্লিউএন