ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

অর্বাচীনে পরাভূত মানবতা

ওয়ারেছুন্নবী খন্দকার

প্রকাশিত : ০৭:৫৩ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:০৭ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিল ৯ বছরের শফিউল আলম। মাঠে খেলা শেষে এসে দেখে তার বাবা-মা’র লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পাঁচ বছরের ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। একদল লোক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশ অভিমুখে আসছে দেখে সেও তাদের দলে যোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর তার বাড়ি থেকে একটু চাল আনতে মন চায়। কিন্তু চাল বহনের ক্ষমতা না থাকায় এক রকম না খেয়েই ৯ দিন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে চলে আসে। উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় একটি ঝুপড়িতে ছোট ভাইকে রেখে খাবারের সন্ধানে বের হয় শফিউল। ফিরে দেখে ভাইটিও নেই সেখানে। একমাত্র বড়বোন কোথায় জানে না। এই পৃথিবীতে বড় একা হয়ে গেল সে।

গুলিবিদ্ধ হয়েও অনেকে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে আগুনে পোড়ানো হয়। চোখের সামনে দা’য়ের কোপে কারো বৃদ্ধ মা’কে জবাই করা হয়। এর মাঝে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পা হারানোদের কান্না। মানবতার এমন পরাজয়ে বাকরুদ্ধ রোহিঙ্গারা। আর নাফ নদীতে ভেসে আসা নারী ও শিশুদের লাশ দেখেও যদি সার্বিক বিষয়টাকে ‘স্থিতিশীলতা রক্ষায়’ মিয়ানমারের প্রচেষ্টা জানিয়ে নৃশংসতাকে সমর্থন দেয়া হয়? তবে তাকে অন্তত বিশ্ব রাজনীতি না বলে বিকৃতি রাজনীতির কাছে মানবতার পরাজয় ধরে নিতে হয়। আর মিয়ানমারকে সমর্থন দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সেই দেশটিকে অর্বাচীন বলাই বাঞ্ছনীয়।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায়ও চীন মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়। আজ আবারো মিয়ানমারের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে চীন। ফলে আপাতত দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা সংকটের মোড়ল সমাধানের পথ আটকে যায়। 

তবে ব্রিটেন এবং সুইডেনের অনুরোধে আগামীকাল বুধবার আবারো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। এতে সমব্যাথীদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও বড় বড় প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগে মিয়ানমারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের যে কোন একটি যদি কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে সেটি আটকে যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে তাই ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, চীন এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমার সরকারের গৃহীত সব ব্যবস্থাকে শতভাগ সমর্থন জানিয়ে চলেছে।

আজ মঙ্গলবার চীন আবারও বলেছে, তারা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের পাশে আছে।

রাশিয়ার অবস্থানও মিয়ানমারের পক্ষে বলে মনে করা হলেও এ সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাবে গনেশ উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের উপর কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার রাখাইনের নৃশংসতাকে  `টেক্সটবুক এথনিক ক্লিনজিং` অর্থাৎ জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের সংগে তুলনা করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোনো মাথা গলাক, সেটা চীন চায় না।

নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্য অবশ্য রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙ্গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সহিংসতার মুখে যেভাবে রোহিঙ্গারা তাদের বাড়ি-ঘর ছাড়া হয়েছে তাতে বোঝা যায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে বেসামরিক মানুষকে নিরাপত্তা দিচ্ছে না।

নিরাপত্তা পরিষদের অপর স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের অবস্থান এখনও পরিষ্কার নয়। তবে  অতীত ইতিহাস এবং পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংকট সমাধানে মানবতা নয়, বড় বাধা ‘মুসলিম’ শব্দটি। সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে বিশ্ব নেতাদের যতটা না আগ্রহী দেখা গেছে কার্যক্ষেত্রে সমস্যা টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা তারচেয়ে বেশি দেখা গেছে।

সম্প্রতি তেহরান টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মার্কিন কলামিস্ট স্টিফেন লেন্ডমেন তাই বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য নিপীড়িত মানুষের জন্য জাতিসংঘের বর্তমান এবং সাবেক মহাসচিবরা কী করেছেন- অর্থহীন কথা-বার্তা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি।’

আর রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে তার মন্তব্য হচ্ছে, ‘একই ধরনের পরিস্থিতি যদি পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের ক্ষেত্রে হতো তাহলে আন্তর্জাতিক সব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিতো।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের ভূমিকাও মানবিক বলা যায় না। বরং মুসলমি শব্দটার কারণে তারা বিব্রতবোধ করছে। কথিত রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দমন অভিযানের প্রশ্নে সম্প্রতি আকস্মিক সফরে মিয়ানমারে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অং সান সু চির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। মোদির সফরের পর পরই সু চি রোহিঙ্গা সংকটকে কাস্মীর সমস্যার সঙ্গে তুলনা করেন।  

গত ৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি ফোরাম অন সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’নামক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ঘোষণাপত্র মেনে নেয়নি ভারত। বরং দেশটিতে থাকা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। মানবতার পরাজয়েও যারা চিরাচরিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না সেই অর্বাচীনদের হাতে মানবতার পরাজয় ছাড়া আর কিছু আশা করা অবান্তর।