কারওয়ান বাজারের যমদূত
ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত : ১০:৪০ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:১০ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার
গান-বাজনা আর অশ্লীল শব্দ শুনে এক শ্রেণির মানুষ ঘটনাস্থলে জড়ো হন। সেখানে উপস্থিত তরুণীদের দেখে আশপাশের মানুষের ভীড় আরো বেড়ে যায়। এরপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বরোগের ওষুধ নিয়ে হাজির হন মজমার মূল ব্যক্তি। নানা রকম আশ্বাস, বিশ্বাস আর প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রচারণা চালান। এ সময় পাশ থেকে পূর্বের ক্রেতারা এসে উপকার পেয়েছেন মর্মে আরো ওষুধ নিতে চান। উপস্থিত দর্শকদের বিশ্বাস আরো গাঢ় হয়। তারাও চেয়ে বসেন ওষুধ। জমে যায় মজমা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চারটি পয়েন্টে প্রতিদিন এ শ্রেণির হকারের ফাঁদে পা দিয়ে ঠকছেন সাধারণ মানুষ। রোগ সারানোর নামে তারা যেসব ওষুধ কিনছেন তাতে তাদের শরীরে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনছে। অনুমোদনহীন ও মানবদেহের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর বিভিন্ন মলম, শালসা কিংবা ট্যাবলেট বিক্রির ফাঁদ এতোটাই নিখুঁত যে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবিশ্বাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এসব অপতৎপরতা বন্ধে প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নজরে পড়ে না।
হকারদের একটা বড় সিন্ডিকেট রয়েছে কারওয়ান বাজার এলাকায়। প্রতিদিন চারটি পয়েন্টে হকাররা বসেন। এর মধ্যে প্রেট্রোবাংলার সামনে, আড়ৎ বাজার, কামার পট্টি এবং এফডিসি সংলগ্ন রেলগেট এলাকায় মজমা বসে। মজমার বাইরে থাকে হকারদের নিজস্ব লোকজন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন রোগের কথা বলে, কেউবা উপকার পাওয়ার কথা বলে আরো শালসা নেওয়ার আগ্রহ দেখান। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে বৃদ্ধ বাবা-মা’র জন্য এসব ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
ওষুধ বিক্রিতে ধর্মকেও পুঁজি করা হয় সেখানে। বলা হয় পবিত্র গ্রন্থের অমুক অমুক জায়গা এটার ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। আবার অনেকে উর্দু ভাষায় কথা বলেন। হকারদের নিজেদের লোকজন এসে উর্দু কথা বাংলায় অনুবাদ করে বলেন ‘তিনি আফগানিস্তান/পাকিস্তান থেকে এই ওষুধটি এনেছেন।’ মাথায় টুপি হাতে তজবি নিয়ে যখন তারা প্রতারণার ফাঁদ পাতেন তখন সে ফাঁদে পা দেন সাধারণ মানুষ।
যা থাকে হকারদের কাছে
তেলে ডোবানো মৃত প্রাণি : কোনো কোনো মজমায় মৃত বিষধর সাপ, কুকুরের মাথা, বেজি, গুইসাপ তেল মাখিয়ে আনা হয়। বলা হয়, এটি জীবন্ত অবস্থায় মানুষের যম, মৃতকালে ব্যথার যম। এগুলো থেকে বের হয় বাজে গন্ধ।হকারদের কেউ কেউ হিন্দি ভাষায় বলেন, এটা ভারতের কামরুপ কামাক্ষা থেকে উৎকৃষ্ট তেল দিয়ে তৈরি। এটি প্যারালাইসিস, বাতসহ প্রায় ২০টি রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। ছোট এক বোতল তেল বিক্রি করা হয় ৫০ টাকায়।
শালসা : হকাররা তাদের স্বভাবসূলভ বাচনভঙ্গিতে বলেন, এসব শালসা তৈরি হয়েছে সমুদ্রের পানির নিচ থেকে নিয়ে আসা শৈবাল, পাহাড়ি গাছ-গাছরা দিয়ে। এটা খেলে শরীরে শক্তি আসবে, যৌন দুর্বলতা কমানোর পাশাপাশি শরীরের ৩৮টি রোগ সারবে। এটা বিক্রি করতে পুরুষদের পাশাপাশি কিছু নারী প্রতারকদের ব্যবহার করা হয়। দাম নেয়া হয় ১০০ টাকা করে।
মজমায় ব্যবহৃত নারীদের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তারা ক্রেতা সেজে আসেন বিভিন্ন রোগের নাম বলে। তারা উপস্থিত সবার সামনে বলেন ‘গত বছর আমি ওষুধ নিয়েছিলাম, ভালো উপকার হয়েছে। আবার লাগবে।’
খালেদা নামের এমন এক নারী এ প্রতিবেদককে বলেন, এটা ছাড়া আমার আর কোনো আয় রোজগার নাই। কারওয়ান বাজারের বস্তিতেই থাকেন তিনি। কত টাকা করে পান হকারদের কাছ থেকে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ১৫০ টাকা করে দেয়া হয়। যা দিয়ে সংসার চালাই।
যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট : মজমায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যৌন উত্তেজক ক্ষতিকর ট্যাবলেট বিক্রি করে হকাররা। এক্ষেত্রে ১০ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণীদের ব্যবহার করা হয়। তারা নানা ধরণের উত্তেজক, কূ-রুচিপূর্ণ কথা বলে বিভ্রান্ত করে পথচারি বা সাধারণ মানুষদেরকে। তারা বিভিন্ন রোগের নিরাময়ক হিসেবে হকারদের কাছ থেকে ওষুধ কিনে অন্যদের উৎসাহিত করেন। যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট প্রতি পাতা (১০টি) দাম ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
দেয়া হয় ধর্মের অপব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআন, হাদিস, বাইবেল, বেদসহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিক্রি করা হয় ওষুধ। ধর্মের কথা শুনে অনেকে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে হকারদের কথা বিশ্বাস করেন।
এ বিষয়ে একটি সরকারী কলেজের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক মাওলানা আহমেদ শরিফ ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদের প্রতি আল্লাহর লানত। শুধু ইসলাম ধর্মই নয় কোনো ধর্মেই নাপাক কোনো বস্তুকে ওষুধ হিসেবে সেবনের কথা উল্লেখ নাই। যেটি শরীরের ক্ষতি করে সেটি ওষুধ হতে পারে না। তিনি সাধারণ মানুষকে প্রতারকদের ফাঁদে পা না দেয়ারও আহ্বান জানান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি খেলে মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া করলেও দীর্ষ মেয়াদে এসব ওষুধ শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে।
দাঁতের মাজন : বাজারের টুথ পাউডারের সঙ্গে ছাই এবং বালি দিয়ে হকাররা তৈরি করেন তাদের টুথ পাউডার। এসব পাউডার ব্যবহারে সাময়িকভাবে দাঁত পরিষ্কার দেখালেও দীর্ঘমেয়াদে দাঁতের ক্ষতি করে। চিকিৎসকরা জানান, এসব ব্যবহারে দাঁতের মাংস সরে যায়, দুর্বল হয়ে যায় দাঁত।
কেন এমন ক্ষতিকারক জিনিস তৈরি করে বিক্রি করেন? এ প্রশ্নের জবাবে হকার ইদ্রিস শাহ দাঁতের মাজনের ব্যাপারে বলেন, এটি ক্ষতিকর না বা ক্ষতিকর কোনো উপাদন এটির মধ্যে নাই। ক্ষতিকারক ওষুধ বিক্রির ব্যাপারে তার উত্তর, আমি ভিক্ষা করে খাই না বরং আমি ব্যবসা করে খাচ্ছি। ওষুধের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরলে তিনি বিশ্বাস করতে চান না। এক পর্যায়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
আরেক হকার শাহ আলম সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, ভাই যার উপকার হয় তারাই এসব ওষুধ কেনেন। আপনার ভালো না লাগলে আপনি নিবেন না। ওষুধের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে তিনিও একমত হতে চান না।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : রাজধানীর একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সালাহউদ্দিন আহমেদ ইটিভি অনলাইনকে বলেন, হকাররা বিভিন্ন কেমিকেল মিশিয়ে সাপ, বেজির তেল তৈরি করে। এগুলো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের ফুসকুরি উঠবে। পাশাপাশি কিডিনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর যৌন উত্তেজক এসব ওষুধ যদি কেউ ব্যবহার করেন, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব ওষুধ ব্যবহারে এক সময় একজন স্বাভাবিক মানুষও যৌন ক্ষমতা হারাতে পারেন।
প্রশাসনের মত : এসব ক্ষতিকর জিনিস জনসম্মুখে বিক্রি করলেও পুলিশ প্রশাসন কেন নীরব সে বিষয়ে তেজগাঁও অঞ্চলে ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ওষুধ সেনসেটিভ বিষয় এটা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মোটেও খাওয়া ঠিক না। তবে হকাররা যে ক্ষতিকর এ ধরণের ওষুধ বিক্রি করে তা আমরা জানলাম। আশা করছি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা সচেতন হলে আমাদের সহযোগিতা আরও সহজ হবে। কোনো প্রতারকই কোথাও প্রতরণা করতে পারবে না।
এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, হকাররা যেভাবে ওষুধ বিক্রি করছে এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে। এ ধরণের প্রতারকের সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে।
তিনি বলেন, হকাররা যে ভায়াগ্রার ট্যাবলেটের কথা বলছে, বাস্তবতা হলো দেশে ভায়াগ্রা নামে কোনো ওষুধের লাইসেন্স নেই। বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি ছাড়া কোনো ধরণের ওষুধ বিক্রির অনুমোদনও দেয়া হয়নি। আমরা কলকাতা হারবালসহ অনেক দোকান সিলগালা করে দিয়েছি এবং এসব দোকানের ব্যানারগুলোও খুলে ফেলা হয়েছে। আমরা আশা করছি রাজধানীর কাওরান বাজার অঞ্চলেও এ ধরনের হকাররা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আর থাকবে না।
আর/ডব্লিউএন