জনপ্রিয়তা হারিয়ে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা এখন দুর্ভোগ
কাজী ইফতেখারুল আলম
প্রকাশিত : ১০:০৯ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১১:৫৪ পিএম, ২ আগস্ট ২০২৩ বুধবার
সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে বিকেলে বাড়ি ফিরে খাওয়া-গোসল সেরে একজন কৃষক যাচ্ছেন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে চিকিত্সক বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ লিখে দিচ্ছেন, সঙ্গে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় ওষুধ। এমন চিত্র বাংলাদেশে কল্পনা করা কঠিন। তবে এ কঠিন কাজটি সহজ করেছিলেন ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন। খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভেবে বিকেলে আউটডোর চালু রেখেছিলেন। কিন্তু তাকে সঙ্গ দেওয়ার মানুষ না থাকায় আড়াই বছরের মাথায় এ সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
আড়াই বছর আগে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নওগাঁর সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন মান্দা উপজেলায় শুরু করেছিলেন এই বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা। এর ফলে অত্র অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষগুলো স্বাচ্ছন্দে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারতেন। এ কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বৈকালিক আউটডোর চিকিৎসাসেবা। কিন্তু চিকিৎসক সংকটের কারণে নওগাঁর চার উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগে চালু হওয়া বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে গেছে।
বৈকালিক আউটডোর চিকিৎসাসেবা সর্বপ্রথম চালু হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর নওগাঁর মান্দা উপজেলা হাসপাতালে এ সেবার চালু করেন ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন।
শুরুতেই অনেকেই এ সেবা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন না। শঙ্কা ছিল কার্যক্রমের সাফল্য নিয়ে। তবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে বৈকালিক চিকিৎসা সেবা। মান্দা উপজেলায় এ সেবা উদ্বোধনের পর থেকে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় সেবা গ্রহণ করেন। যাদের অধিকাংশই মহিলা ও শিশু।
ওই সময় হাসপাতালের ১১জন চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ সেবার সাফল্য দেখা দেওয়ায় গত বছর ১৬ আগস্ট জেলার বদলগাছী উপজেলা হাসপাতালে একই কার্যক্রম চালু হয়েছিল। সেখানেও বৈকালিক এ চিকিৎসাসেবা সাফল্য অর্জন করেছিল।
এরপর নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলায় গত বছরের ১ অক্টোবর এ সেবার উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি। এরপর একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে এ সেবার উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ কার্যক্রমে নওগাঁর চারটি উপজেলায় সকাল ও বিকাল আউটডোরে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো। সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একজন মহিলা ও একজন পুরুষ ডাক্তার নিয়মিত রোগী দেখতেন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসাপত্রের পাশাপাশি তাদের উন্নত মানের ওষুধও সরবরাহ করা হতো।
নওগাঁর বদলগাছী ইউনিয়নের কৃষিজীবী মো. মোমেন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সারাদিনের কাজ শেষ করে বিকেলে হাসাপাতালে গিয়ে সেবা পেতাম। কিন্তু এখন বিকালে আউটডোরে আর রোগী দেখা হয় না।
বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে গেলেও ওই চার হাসপাতালে ভুলবশত অনেক রোগী এখনও আউটডোরে চিকিৎসাসেবা নিতে যান। এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পত্নীতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক।
বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা বর্তমানে কেন চালু নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে নওগাঁর সাবেক সিভিল সার্জন ও এই চিকিৎসা সেবার স্বপ্নদ্রষ্টা ডা. এ কে এম মোজাহার হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন এটিকে বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখায় এ সেবাটি আর ধারাবাহিকতা পায়নি। যার ফলে কিছু ডাক্তারের আগ্রহ থাকলেও একটি স্বপ্নের মৃত্যু হয়ে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই সেবা কর্মসূচির প্রথমদিকে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ৩৩তম বিসিএস চিকিৎসকগণ যারা পরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে চলে যান। ফলে এই সেবাকে কেউ আর নিজের কাজ মনে করেননি। এছাড়া বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা কম হলেও এটি খুব সুন্দরভাবে চালানো যেত।
তিনি বলেন, বিকেলে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে ব্যাপক টাকা খরচ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। অধিক টাকা খরচ করে চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এসব মানুষের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালুর পর নওগাঁর মান্দায় দেশের প্রথম এই সেবা শুরু হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকদের চাকুরির মেয়াদ (চুক্তিভিত্তিক) ২ বছর বর্ধিত করা হলেও জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতে এ রকম সুবিধা দেওয়া হয় নাই। জেলা পর্যায়ে বিশেষ করে যারা জনস্বার্থে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন তাদের মূল্যায়ন ও চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ দিলে এ ধরণের কর্মসূচি এগিয়ে যাবে। এই সেবাকে পুনরায় চালু করতে পারলে নওগাঁর চব্বিশ লাখ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় আমুল পরিবর্তন ঘটবে। এটি স্বাস্থখাতের একটি মডেল হতে পারে।
কেআই/ডব্লিউএন