ভোগান্তি যেন সন্দ্বীপবাসীর নিত্যসঙ্গী
কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক
প্রকাশিত : ০৯:১২ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১০:৫১ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার
চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন উপজেলা সন্দ্বীপ যাতায়াতের একমাত্র উপায় নৌপথ। এই দ্বীপবাসীকে গুপ্তছড়া-কুমিরা ঘাট দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে আনুমানিক ৩ হাজার যাত্রী সন্দ্বীপ-চট্টগ্রামে আসা যাওয়া করেন। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে ঘাটের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ায় এ পথে যাতায়াতকারী শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ সবাইকে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ট্যাক্স-টোলসহ বিভিন্ন খাতে বিআইডব্লিউটিসি, জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা পায়। তারপরও সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে কাঁদামাটি মাড়িয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় হাজারো দ্বীপবাসীকে।
অননুমোদিত স্পিডবোট, মালবাহী ট্রলার কিংবা জরাজীর্ণ সি-ট্রাকে করেই সন্দ্বীপবাসী পাড়ি দেন উত্তাল সাগর। ইতোমধ্যে পুরোনো জেটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে কিছুদিন পরপরই মৃত্যু মিছিলে যুক্ত হয় নতুন নতুন প্রাণ। চলতি বছর ২ এপ্রিল গুপ্তছড়া ঘাটে ‘এসটি সালাম’ নামের সি-ট্রাক থেকে নামতেই ‘লাল বোট’ উল্টে ১৮ যাত্রী নিহত হন। ২০০১ ও ২০০৬ সালে ট্রলার ডুবিতে প্রাণ হাঁরিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ।
এর আগেও একাধিকবার নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এ দ্বীপের অসংখ্য মানুষ। প্রতিবার দুর্ঘটনা শেষে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু দোষীদের বিচার হয় না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও এ দ্বীপের সাড়ে চার লাখ মানুষ পায়নি যাতায়াতের একটি নিরাপদ রুট। এমনকি ভাগ্যে জোটেনি একটি টেকসই স্টিমার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিসির পৃথক ইজারাদার ও কমিশন এজেন্ট থাকায় মানুষের দুর্ভোগ অত্যধিক বেড়েছে। স্পিডবোটে যাওয়া যাত্রীরা ইজারাদারের তৈরি করা কাঠের জেটিতে পারাপারে সুযোগ পেলেও তার পাশেই কোমর সমান কাদা পানি মাড়িয়ে যাত্রীদের উঠতে হয় সি-ট্রাকে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের `আমরা সন্দ্বীপবাসী` সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. রফিকুল মাওলা বলেন, `যাত্রী পারাপারে বিআইডব্লিউটিসি ও জেলা পরিষদ পৃথকভাবে থাকায় এ রুটে যাত্রীদের ভোগান্তিও বেশি। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এখানে কাদামাটি মাড়িয়ে অননুমোদিত নৌযান দিয়েই উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।`
যাত্রীদের অভিযোগ, জেলা পরিষদও চট্টগ্রাম এবং সন্দ্বীপ রুটে চলাচল করা যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মনোযোগী নয়। উভয় ঘাট ইজারা দিয়ে প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকার খাজনা আদায় করছে জেলা পরিষদ। অথচ যাত্রী সেবার বেলায় তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না।
অপরদিকে, বিআইডব্লিউটিসির সি-ট্রাকে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের কাছ থেকেও প্রতি ১০০ টাকায় সাড়ে ১২ টাকা টোল নেওয়া হয়। এভাবে বছর শেষে তাদের আয়ের পরিমাণ চার কোটি টাকা ছাড়ালেও নদীর দুই ঘাটে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই সরকারি এ সংস্থার। ঘাটে নেই বিদ্যুতের ব্যবস্থাও।
গত ২ এপ্রিল লাল বোট দুর্ঘটনার বেঁচে যাওয়া শান্তি লাল মজুমদার বলেন, নদীতে পরে যাওয়ার পরে আলো না থাকায় কিছুই দেখছিলাম না। আমি সেদিন ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি। সেদিন ঘাটে যদি কোনো আলোর সুবিধা থাকতো বহু মানুষ বেঁচে যেত। উদ্ধার তৎপরতায় আলোর সংকটে অনেক লোকের প্রাণ গেছে।’
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যান জ্ঞান রঞ্জন শীল ইটিভি অনলাইনকে বলেন, এই রুটে অনেক দিন ধরেই দুর্ভোগ রয়েছে। এই ঘাটে বিআইডব্লিউটিসির সি ট্রাক যাত্রী পারাপার করে। ঘাট ইজারাদারও তার নিজস্ব নৌযান দিয়ে যাত্রী পার করে যা জেলা পরিষদের দেখভালে রয়েছে। সমস্যা বিদ্যমান থাকার পরও সরকার এই রুটের জন্য একটি ভালো স্টিমারের অনুমোদন দিয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্টিমার অনুমোদন দেওয়া হলে তা এখনও অত্র এলাকায় আসেনি।
যাত্রীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই অতিরিক্ত ভাড়ায় অবৈধ স্পিডবোট ও মালবাহী ট্রলারে করে যাত্রী পারাপার করছেন জেলা পরিষদের ইজারাদার এস এম আনোয়ার চেয়ারম্যান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে এস এম আনোয়ার হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, যাত্রীদের নিরাপদে যাতায়াত করাতে আমি সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি। অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে এখানে। বিধায় এ কারণে কিছু সমস্যা রয়েছে। এছাড়া নৌ দুর্ভোগের জন্য উন্নত যান দরকার রয়েছে বলে মনে করি।
‘সন্দ্বীপ (গুপ্তছড়া-কুমিরা) নৌ রুটে ভোগান্তির জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না থাকাকে মূল কারণ হিসেবে মনে করছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম।
তিনি ইটিভি অনলাইনকে বলেন, এই রুটে সাগর প্রচণ্ড উত্তাল থাকার কারণে যাত্রীদের জোয়ার ভাটা অনুযায়ী চলাচল করতে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি জেটি নির্মাণ করতে যাচ্ছি। যাতে নৌযানগুলো পল্টুনের সাথে ভিড়তে পারে, ফলে যাত্রীরা খুব নিরাপদে কূলে নামতে পারবেন। যেহেতু গুপ্তছড়া ঘাটে ক্রমাগত ভাঙ্গণ অব্যাহত আছে তাই এখানে জেটি অথবা পল্টুন টেকানো কঠিন। তবুও আমরা যাত্রীদের কল্যাণে এটি করবো।’
জেলা পরিষদ প্রতিদিন পঁচাত্তর হাজার টাকা ঘাট ইজারাদা বাবদ আদায় করে অথচ যাত্রী সেবার মান বাড়াতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন পঁচাত্তর হাজার টাকা জেলা পরিষদকে ইজারা দিতে হয়, তার মানে এ নয় যে, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে নৌযান চালাবে তারা। আমরা ইজারাদারকে বলে দিয়েছি সূর্য ডোবার পরে কোনো প্রকার নৌযান যেন না চালায়। এ ব্যাপারে আমাদের নজরদারি রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, দুপাড়ের জেটির ভাড়া হিসেবে বিআইডব্লিউটিএ কে প্রতি বছর চল্লিশ লাখ টাকা দিতে হয়। বিআইডব্লিউটিসির কমিশন এজেন্টের সাথে অনেক সময় ইজারাদার ও জেলা পরিষদের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়। যেমন চলতি বছরের ২ এপ্রিল লাল বোট ডুবি হয়েছে কমিশন এজেন্টের ভুলের কারণে। এক্ষেত্রে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
নৌ যাতায়াতে দুর্ভোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, নৌ দুর্ভোগ সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘ দিনের প্রধান সমস্যা। গুপ্তছড়া কুমিরা নৌ রুটে সরকারের তিনটি সংস্থা জড়িত। ফলে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার অভাবে আমাদের প্রচেষ্টা টুকু অনেক সময় বিফলে যায়। আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে সন্দ্বীপবাসীর এই জনদুর্ভোগ দেখাতে সরাসরি নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানকে সন্দ্বীপ গুপ্তছড়া ঘাট পরিদর্শন করাই। যার ফলে জেটি পুনঃনির্মাণের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছি এবং বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম এসে সয়েল টেস্টসহ পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে রিপোর্ট প্রদান করেছে। এতে বলা হয় অতিরিক্ত নদী ভাঙ্গনের কারণে পুনঃ নির্মাণকৃত জেটিও টেকসই হবে না। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে ছেচল্লিশ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়। অচিরেই জেটির কাজ শুরু হবে।
নতুন স্টিমার সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার ১ম বছরেই আগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্টিমার সার্ভিস চালু করি। ইতোমধ্যে, সন্দ্বীপের জন্য ২৬ কোটি টাকায় ৫০০ আসনের একটি নতুন স্টিমার একনেকে অনুমোদিত হয়েছে যা ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটে নিরাপদে সমুদ্র পারাপারে সক্ষম।
কেআই/ডব্লিউএন