ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

পর্ব-৫

জীবনযাপনে সচেতন হোন, হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকবে

ডা.এম আর খান

প্রকাশিত : ০৩:৪১ পিএম, ২ অক্টোবর ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ০৪:৪৮ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার

আমরা সবাই সুস্থ থাকতে চাই । সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে চাই। আর সুস্থতার জন্যে যেটি সবচেয়ে বেশি দরকার, সেটি হলো নিজের উদ্যোগ। অর্থাৎ আমকে চাইতে হবে যে, আমি সুস্থ থাকবো এবং সুস্থতার জন্যে প্রয়োজনীয় অভ্যাসগুলো আমি মেনে চলবো, যথাযথভাবে অনুসরণ করবো। সেইসঙ্গে যা যা বর্জন করা উচিত তা-ও আমি অবশ্যই বর্জন করবো । একটি আনন্দময় সুস্থ জীবন উপভোগের জন্যেই আমাকে তা পারতে হবে।

অনেকে বলেন, ধূমপান ছাড়বো কীভাবে? আমি বলি, ধূমপান যদি ছাড়তে চান তবে আপনার নিজের ইচ্ছাটাই যথেষ্ট যে,আমি আর কখনো ধূমপান করবো না। এভাবে সব ক্ষেত্রেই শুধু নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ নিরাময় ও সুস্থতার পথে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা অধিকাংশ মানুষ আজ ভুল খাদ্যাভ্যাসের দিকে ঝঁকে পড়ছি। স্বাস্থ্যঘাতি নানারকম খাবার এখন একটু একটু করে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এখন বিভিন্ন ধরনের বোতলজাত জুস,সফট ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস-এর প্রতি মাত্রারিক্তভাবে আসক্ত। অথচ আপনার শরীরের জন্যে, বিশেষ করে কিডনির সুস্থতার জন্যে দরকার হলো পানি । অন্যদিকে এসব ড্রিংকস ও জুস শিশুসহ যেকোনো বয়সের মানুষের কিডনির ক্ষতির কারণ । সুস্থ থাকতে সবারই এ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে ।

মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে নিরাময় ও সুস্থতার এক সহজাত শক্তি । ডা. হার্বার্ট বেনসন বলেছেন, ‘একজন মানুষ রিলাক্সেশন,মেডিটেশন,ব্যায়াম ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।’ এর প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্তই আমরা দেখছি কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাবের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে এখানে সুস্থতার জন্যে সঠিক জীবনাচারে মানুষকে ভালোভাবে সচেতন করে তোলা হচ্ছে । নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে । নিজেদের জীবনে যারা এসব আন্তরিকভাবে অনুসরণ করছেন তারা উপকৃত হচ্ছেন,সুস্থ আছেন,ভালো আছেন।

অনেক হৃদরোগী আছেন,যাদের হয়তো একবার এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস অপারেশন করা হয়েছে; কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল,আবার বুকে ব্যথা,নতুন ব্লকেজ ইত্যাদি । তিনি আবারও অসুস্থ হতে শুরু করলেন । অর্থাৎ চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে ঠিকই,কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটে চলছে। এ দুর্ভোগ তেকে মুক্তি পাওয়ার পথ একটাই-আপনার জীবনযাপনের প্রতি মনোযোগী হন । স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন । ব্যায়াম করুন । এবং অবশ্যই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা থেকে যতটা সম্ভব দূর থাকুন ।

করোনরি হৃদরোগের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই টেনশন । টেনশন যে শুধু হৃৎপিন্ডেরই ক্ষতি করে তা নয়;বরং আমাদের সার্বিক সুস্থতার পথেও এটি একটি প্রধান বাধা । তাই সুস্থ থাকতে হলে প্রথম কথা হলো, আপনাকে টেনশনমুক্ত হতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে হবে। টেনশনমুক্ত থাকার কথা উঠলেই কেউ কেউ বলেন,শিশু এবং পাগল ছাড়া বাকি সবাই নাকি টেনশনে ভোগে । আমি তখন তাদেরকে রাসুলুল্লাহর (স.) জীবনের কথা বলি। তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং এর প্রেক্ষিতে তাঁর প্রশান্তচিত্ততা,স্রষ্টায় বিশ্বাস ও ধৈর্যের দিকে তাকাতে বলি।

টেনশনের মতো আপনার হৃৎপিন্ডের আরেক শত্রু হলো আপনার রাগ। রাগ-ক্রোধ আপনাকে নানাভাবে অশান্ত করে তোলে, আপনার মধ্যে স্ট্রেস তৈরি করে,আপনাকে কুরে কুরে খায় । তাই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া অর্থাৎ রাগ বর্জন খুব জরুরি। ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’-কোয়ান্টামের এই কথাটি ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব পছন্দ করি এবং সবাইকে বলি ।

একেকজন একেকভাবে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল খুঁজে নিতে পারেন । যেমন,রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিন । ভীষণ কঠিন প্রকৃতির লোক ছিলেন তিনি ।লৌহমানব বলা হতো তাকে । কিন্তু রেগে গেলে তিনি চুপ করে যেতেন,কোন কথা বলতেন না । আমরাও এ বিষয়গুলো নিজেদের মতো করে অনুসরণ করতে পরি । এক্ষেত্রে আমি নিজে কিছু টেকনিক অবলম্বন করি । যেমন,রাগ আসতে শুরু করলে ভাষা বদলে ফেলি,হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করি । যে মানুষটির কথায় বা আচরণে আমার রাগ হতে চাচ্ছিল,তিনি তখন একটিু বিস্মিত হন এবং সে বিষয়ে আর কথা বাড়ান না,থেমে যান । আমিও তখন নিজেকে সহজেই সামলে নিতে পারি । কেউ কেউ বলেন,এডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করতে গেলে এক-আধটু রেগে যেতে হয় । কিন্তু সত্য হলো, এডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনার জন্যে দরকার ঠান্ডা মাথয় সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া ও কাজ করা । কিন্তু রেগে গেলে তো আপনি সেটি কখনোই করবেন না । কারণ রেগে গেলে সে মুহূর্তে মানুষের বোধ আর হিতাহিত জ্ঞান কাজ করে না । তখন ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে আরো বেশি ।

জীবনে চলার পথে আরো এক;টি বিষয় আমাদের অসুস্থ করে তোলে; সেটি হলো নেতিবাচকতা-নেতিবাচক কথা,চিন্তা ও কাজ । কাজ শুরু করার আগে শুধু নেতিবাচক চিন্তা করে আর অকারণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে আমরা অনেক সময় ব্যয় করে ফেলি-এটা করলে কী হবে, কে কী বরবে ইত্যাদি । কিন্তু আসল কথা হলো ম আপনি যদি মনে করেন কাজটা ভালো ও সৎ নিয়তে কাজ করুন,আল্লাহ সাহয্য করবেন। আর কাজ করতে গিয়ে আমরা যেন নাম যশ খ্যাতি প্রশংসার আসক্তিতে আক্রান্ত না হই । কারণ এ আসক্তিও আমাদের অনেক অশান্তি আর অসুস্থতার জন্যে দায়ী ।

প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় নিত্যনতুন অনেক ওষুধ আবিষ্কিৃত হচ্ছে সত্যি,কিন্তু জীবনের এ দিকগুলেঅর প্রতি কোনোরকম মনোযোগ দেয়ার সুযোগ সেখানে নেই । আমার খুব ভালো লাগে যে,কোয়ান্টাম এ বিষয়গুলো মানুষের সমনে তুলে ধরছে।

কোয়ান্টাম মেথধ কোর্সে অংশ নিয়ে আমি দেখেছি,অসংখ্য মানুষ এখানে এসে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা,দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাপনের প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছেন । সমস্ত নেতিবাচকতার বৃত্ত ভেঙে তারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন ।যিনি এসেছিলেন রোগ শোক জরা ব্যাধি অস্থিরতা দু:খ নিয়ে-মনের ও বিশ্বাসের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে তিনি সুস্থতার পথে এগিয়ে যেতে পারছেন । কারণ যেকোনো রোগমুক্তি এবং সর্বোপরি পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্যে মানসিক চাপমুক্তি ও প্রশান্তিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ । সে অর্থে,কোয়ান্টাম সত্যিই মানুষকে সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন ও কর্মব্যস্ত সুখী জীবনের আলোকিত পথে পরিচালিত করছে ।

** অধ্যাপক ডা. এম আর খান বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ ও জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন। তিনি কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব আয়োজিত হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে এ বক্তব্য দেন।

//এআর