‘মুকুট হারালে কষ্ট হয় না, কষ্ট হয় সমাজের কথায়’
সোহাগ আশরাফ
প্রকাশিত : ১১:০৮ পিএম, ৪ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ১০:১১ এএম, ৭ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার
‘মাথার মুকুট হারালে কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় ঘুনে ধরা সমাজের নোংরামি দেখে। যে সমাজ একটি কিশোরী মেয়ের বিয়ে দিলে কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদ করে সংগ্রামী জীবনের সাফল্য দেখলে। ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার প্রথম বিজয়ী জান্নাতুল নাঈম অপরাধ করেছে। সেজন্য সে অনুতপ্ত। কিন্তু তাকে নিয়ে যে নোংরামি হচ্ছে তা কি গ্রহণযোগ্য এই সচেতন সামাজের কাছে!’
‘যে কষ্ট নিয়ে মেয়েটি পরিবার ছেড়েছে, নিজেকে তৈরির জন্য সংগ্রাম করেছে, সেই কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে সাফল্যের মুকুট পরে। এভ্রিল ভালো নেই। এ সমাজই তাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। মুকুট হারোনর কষ্টের চেয়ে মানুষের দেওয়া কষ্ট তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। ’
বিয়ের কথা গোপন করার কারণে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ মুকুট প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনি অনেক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ মনোনীত করা হয়েছে জেসিয়া ইসলামকে। তিনি আগামীতে চীনে অনুষ্ঠেয় মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছেন।
‘কেমন আছেন এভ্রিল’- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ বলেন’, ‘এভ্রিল ভালো আছে, আবার ভালো নেই। কি করে ভালো থাকে? পার্সনাল লাইফ নিয়ে যেখানে টানাটানি সেখানে ভালো থাকা যায় না। সবার একটাই অভিযোগ- কেন আমি বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম। হুম, আমি গোপন রেখেছি। এটার জন্য আমার শাস্তি আছে। শাস্তি হয়েছে। তাছাড়া আমি কখনও এটাকে বিয়ে বলে মেনে নেইনি। কখনও আমি মনেও করিনি আমি বিবাহিত। কারণ আমি কিশোরী ছিলাম আর আমাকে জোড় করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কোনোদিন বিয়ে হতে পারে না। তারপরও শাস্তি দিলে তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে টানাটানি করে আমাকে যে স্তরে নামিয়ে আনা হচ্ছে তা শুনে কি করে ভালো থাকি! আমার অতীতকে টেনে আমার ভবিষৎটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে এই সমাজ।’
ফেসবুক প্রতিক্রিয়ায় এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘সামাজিক চাপ ও নিয়মের কাছে মাথানত করে মুকুট দিয়ে দিয়েছেন এভ্রিল। হাসি মুখেই তা তুলে দিয়েছেন আয়োজকদের হাতে। যা এখন অন্যের মাথায় উজ্জল হয়ে জ্বলছে। কিন্তু অন্ধকারে নিমজ্জিত সংগ্রামী মেয়েটির ভবিষৎ। হয়তো আজকের এই অন্ধকার কাটিয়েও একদিন মেয়েটি ঠিকই তার জায়গা করে নিবে। এমুহূর্তে এটাই করা উচিৎ জান্নাতুল নাঈমের। সামাজকে দেখিয়ে দেওয়া উচিত সে আসলেই পারে।’
এ প্রসঙ্গে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস বলেন, ‘প্রতিভা আর ইচ্ছে থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব। মানুষের জীবন অঙ্ক কষে মেলানো যায় না। এভ্রিল যদি বিয়ে করেও থাকে সেটা বাল্যবিবাহ। তা হলে বুঝতে হবে, তার স্ট্রাগল পাওয়ার আছে! সে প্রচণ্ড স্ট্রাগল করে আজকে এই পর্যায়ে এসেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। একটা মানুষ যখন তার ভালোটা দিতে চায় তখন তাকে উৎসাহিত করা উচিৎ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় বিবাহিত প্রার্থী গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে সে মিথ্যা বলেছে। এটা তার ঠিক হয়নি। কারণ প্রত্যেকটা প্রতিযোগিতায় কিছু নিয়ম থাকে। এভ্রিল এটা খারাপ করেছে। কিন্তু এতটা স্ট্রাগল করে এত দূর এসেছে যে মেয়ে আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে তাকে ছোট করা হচ্ছে- এটা ঠিক নয়। আমি চাই না আবারও কোনো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটুক। এজন্য সবাইকে বলব, এভ্রিল নিয়ম ভঙ্গ করেছে, এটা ভুল। তবে সে যে ভালো কাজ করেছে এজন্য তাকে অভিনন্দন জানানো উচিৎ। কারণ আগামীতে ওকে দরকার। আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছি, মানুষ যেখানে হারে সেখান থেকেই তার যুদ্ধ শুরু হয়। আমি মনে করি তার এই হারায় সামনে আরো একটা জয় অপেক্ষা করছে। জীবনে যে ভুল করেছে সেটা থেকে শোধরানোর সুযোগ তাকে দিতে হবে।’
পরিচালক দীন মোহাম্মদ মন্টু লিখেছেন, ‘জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল একটি নাম। জীবন নামক কঠিন সংগ্রামের একটি নাম। যে বাল্য বিবাহকে পদদলিত করে এত দূর এসেছে। বাংলাদেশে একমাত্র মেয়ে যে কিনা বাইকের বিভিন্ন কসরত দেখাতে পারে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে হাইওয়েতে মোটর বাইক চালাইতে পারে--এভ্রিল তুমিতো এমনিতেই সেরা, দরকার কি আছে তোমার মিস ওয়ার্ল্ড এর মুকুট?
এক ধরনের মানুষ আছে যারা মানুষের ব্যক্তি জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে বেশি পছন্দ করে, কান না দিয়ে তোমার গন্তব্য তুমি পৌছে যাও। এতগুলো প্রতিযোগীর মধ্যে তোমাকেই আমার যোগ্য্ মনে হয়েছে। কে কি বলল তা ধার ধারিনা। তুমিই সেরা জান্নাতুল নাঈম। তুমি যে পার সেটা প্রমাণ করেছো, সাবাস এগিয়ে যাও।
নাট্যনির্মাতা ইমরান হোসেন ইমন লিখেছেন, জান্নাতুল নাইম মেয়েটার নামের অর্থ সবার জানা। জান্নাত মানে বেহেস্তে। কিন্ত পায়ে পায়ে অনেক বাধা আসবে। মেয়েটার জন্য দোয় রইল।
লেখিকা তসলিমা নাসরিন লিখেছেন, ‘জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের বাবা গ্রামের গরিব চাষী। ১৬ বছর বয়সে এভ্রিলকে জোর করে বিয়ে দেন। আমার বাবা ধনী, নামী ডাক্তার, মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ছিলেন। কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে আমার বাবা বলে দিতেন, আমার মেয়ে পড়াশোনা করবে, বড় হবে। তারপর বিয়ে করতে চাইলে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করবে।
এভ্রিলের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তাকে টিউশনি করতে হয়েছে, কলেজে পড়তে হয়েছে। বারো ক্লাস পর তার আর পড়া হয়নি। আমার বাবা মা আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে, পরম আদর যত্নে রেখেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন ডাক্তারি পড়তে। আমি ডাক্তারি পড়েছি। ডাক্তার হয়েছি।
এভ্রিল ছিল অসহায়। খাওয়া জোটেনি, টাকা জোটেনি। স্ট্রাগল করেছে বছরের পর বছর। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটি বাইক কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছে। ওর আরো বড় হওয়ার স্বপ্ন।
উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির নবরাত্রি মিলনায়তনে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু উপস্থাপিকা শিনা চৌহান জানিয়েছিলেন, প্রথম হয়েছেন জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। এ ঘটনার পর থেকেই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে চলে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভ্রিলের বিয়ের ছবি ছড়িয়ে পড়লে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন আয়োজকরা। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিচারকদের রায় তোয়াক্কা না করেই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী এভ্রিলকে বেছে নিয়েছিলেন আয়োজকরা। জেসিয়াকে শুরুতে দ্বিতীয় রানারআপ করা হলেও পরে জানানো হয়, তিনি হয়েছেন প্রথম রানারআপ।
এসএ/ডব্লিউএন