ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ব্ল্যাক বেঙ্গল বদলে দিল প্রতিবন্ধী শাকুলের জীবন

ইয়াসির আরাফাত রিপন

প্রকাশিত : ০৪:১০ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১২:২৯ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

মোহাম্মদ শাকুল ইসলামের দুই হাতই নেই। বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে শাকুল তৃতীয়। দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই তার বেড়ে ওঠা। অভাব যেন পিছু ছাড়ত না তাদের। পরিবারজুড়ে তাকে নিয়ে ছিল শুধুই গঞ্জনা। অভাবের সংসারে শান্তি ছিল অধরা।

২০০২ সালে বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে তার দুই হাতের শক্তি হারিয়ে যায়। পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাত দুটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাই কোনো কাজ বা ব্যবসা করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মূলত: এরপর থেকেই অভাবের সংসারে শাকুল যেন বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

এভাবে চলে যায় একটি বছর। পরে বাবার সঙ্গে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের দুটি ছাগী কেনেন। সেই থেকে তার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন শুরু। কেনা ছাগী দুটি নিয়মিত বাচ্চা দেওয়ায় এক বছরের মাথায় তার ছাগলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬টিতে। এখন তার ২৫টি ছাগল। এখন শুধু শাকুল নয়, তার পুরো পরিবারের ভরণ পোষণের খরচ জোগার হয় এই ছাগল থেকেই।

শাকুলের জীবনে অমানিশার অন্ধকার কেটে গেছে। কারণে-অকারণে আর গঞ্জনা সহ্য করতে হয় না তাকে। ছনের বেড়ার পরিবর্তে তার এখন কংক্রিটের ঘর। কেটে গেছে অভাব অনটন আর ভাত-কাপড়ের অনিশ্চয়তা। তার সন্তান এখন স্কুলে যায়।

মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে বিশ্বখ্যাত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগল পালন করেন তিনি। তার দেখাদেখি গ্রামের অন্যরাও ছোট ছোট খামার তৈরি করে পালন করছেন এই জাতের ছাগল। তার মতো অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।

শাকুল ২০১২ সালে সাহেদা নামে একজনকে বিয়ে করেন। তার সংসারে সাদিয়া নামে চার বছর বয়সী এক কন্যা সন্তান আছে।

শাকুলের জন্ম গোপালপুর গ্রামেই। এ গ্রামে ঢুকতেই মাঠে মাঠে দেখা মিলবে অসংখ্য ছাগল। নারী-পুরুষ ও শিশুরা ছাগল চরাচ্ছে। মাঠেই কথা হয় শাকুলের সঙ্গে। তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি মাঠে বসেই শোনালেন তার দিন বদলের গল্প।

শাকুল বলেন, আমি যখন বিদ্যুৎস্পষ্ট হই, তখন আমাদের সংসারের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এখনও খুব ভালো সেটাও বলব না। তবে এখন অনেক সুখে আছি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমি কোনো ভিক্ষাবৃত্তি করছি না। আমি নিজে প্রতিবন্ধী হলেও, আমি ভিক্ষুক না। আমি একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি।

তিনি বলেন, আমি এক সময় খুব হতাশায় ভুগতাম। পরিবারের অন্য সদস্যরা আমাকে খুব ভালো চোখে দেখত না। কারণ আমি কাজ করতে পারিনা। আমার দুই হাত নেই। নিজে খুব হতাশার মধ্যে থাকতাম। কিন্তু এই হতাশা থেকে আমাকে আলোর পথ দেখায় ছাগল পালন।

যেভাবে ছাগল পালন শুরু : শাকুল জানান, ২০০২ সালে যখন বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে আমি দু’হাত হারাই, তখন চোখের সামনে অন্ধকার দেখতাম। পরে আমার বাবার সহযোগিতায় প্রথমে দুইটি ছাগী ব্ল্যাক বেঙ্গল কিনি। এক বছরের মধ্যেই দুইটি ছাগল থেকে ৬টি ছাগল হয়। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আমার ২৫টি ছাগল। গত ঈদুল আজহাতে ৬টি ছাগল ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এখন প্রতি বছরেরই বাড়ছে ছাগলের সংখ্যা।

শাকুলের স্ত্রী সাহেদা জানান, আমার স্বামী ছাগল পালন করে সংসারের কষ্ট দূর করেছে। আমরা এখন অনেক সুখে আছি। আমাদের মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আমার স্বামী প্রতিবন্ধী বলে সমাজে আমরা অবহেলিত নই, আমরা কারো কাছে হাত পাতি না। আমার স্বামী এখন একজন সাবলম্বী ব্যক্তি। সে নিজেই আমার সংসার চালায়। কারো কাছে হাত পাততে হয় না তাকে।

শাকুল বলেন, আমি এক সময় মাসে মাত্র ৬শ টাকা হারে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতাম। যেটা দিয়ে আমার সংসার বা নিজের খরচ চলত না। এখনও ভাতা পাই তবে, আমার এখন ভাতার প্রয়োজন হয়না। তার মতে, অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হয় এ ধরনের ছাগল পালনে। তাই তিনি সকল বেকার এবং প্রতিবন্ধীদের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের পরামর্শ দেন।

শাকুলের দেখাদেখি ছাগল পালন করে সফলতা পান গোপালপুর গ্রামের অপর বাসিন্দা আয়েশা খাতুন। কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি ইটিভি অনলাইনকে বলেন, আমার সংসারে অভাব থাকত। শাকুলের দেখাদেখি আমি মাসে অল্প করে টাকা জমিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল কিনে ছাগল পালন শুরু করি। এখন আমার সংসারে আর অভাব নেই। তবে কোনো এনজিও বা সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও কিছু ছাগল পালন করতে পারতাম। বর্তমানে আয়েশার আছে ৫টি ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল।

আর/ডব্লিউএন