ইটিভি অনলাইনকে বৃন্দাবন দাস
কল্পনার গল্প পর্দায় দেখতে ভালোলাগে
সোহাগ আশরাফ
প্রকাশিত : ০৩:০০ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৬:৪৩ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০১৭ রবিবার
পাড়ার খেলার মাঠের সেই দূরন্ত বালকটি এখন চার দেয়ালের ঘেরাটোপে। কলম, খাতা আর কম্পিউটারের কি-বোর্ডের সঙ্গে তাঁর নিত্য সখ্য। স্বপ্ন দেখেন। কল্পনার ঘরে গল্প খোঁজেন। ভাবনার জানালায় তাঁর প্রতিনিয়ত উঁকি দেয় সাধারণ মানুষের জীবনাচার ও বাস্তবতার গল্প। বলছি এই সময়ের জনপ্রিয় নাট্যকার ও অভিনেতা বৃন্দাবন দাসের কথা।
বৃন্দাবন দাসের জন্ম পাবনার চাটমোহরে। মফস্বলে বেড়ে উঠা দূরন্তপনা কিশোর বৃন্দাবনের ইচ্ছে ছিলো ফুটবলার হবেন। সেটি আর হয়ে উঠেনি। তিনি এখন জনপ্রিয় নাট্যকার। যে মানুষটি অন্যের জীবনের গল্প সুনিপুনভাবে তুলে ধরেন দর্শকদের সামনে, আজ একুশে টেলিভিশন অনলাইনে’র একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাঁর জীবনের গল্প।
বৃন্দাবন দাসের মূল পরিচয় নাট্যকার হলেও তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। পাশাপাশি ছোটপর্দায় অভিনয়ও করেছেন সমানতালে। একাই নন স্বপরিবারে অভিনয় করছেন। স্ত্রী শাহনাজ খুশি শুরু থেকেই বৃন্দাবনকে যোগ্য সমর্থন দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি দুই ছেলে (জমজ) সৌম্য ও দিব্যও ঈদের একটি নাটকে (হ্যাপি ফ্যামিলি) অভিনয় করেছেন। নাটকটি বৃন্দাবন দাশেরই লেখা। বৃন্দাবন নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।
বৃন্দাবন দাসের লেখা নাটকগুলো টেলিভিশনের পর্দায় নিয়মিত দেখা গেলেও বর্তমানে অভিনয় করতে খুব কমই দেখা যাচ্ছে এই ‘হাসির গুরু’কে। অথচ দর্শক তাঁর অভিনয়কে খুবই ভালোবাসেন। দর্শক চাহিদা থাকতেও কেনো বৃন্দাবন পর্দার সামনে কম আসেন এমন প্রশ্নের জবাবে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি নিজেকে নাট্যকার হিসেবে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। হ্যাঁ; এটা ঠিক যে, দর্শকরা আমাকে অভিনয়ে দেখতে চায়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলবো- আমি গল্প নিয়ে খেলতে চাই। কল্পনার গল্পগুলো বাস্তবে দেখতে চাই। এটি আমার ভালো লাগে। আমার লেখা নাটক উচ্চবিত্তদের ড্রইং রুম থেকে সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে যাক সেটাই আমি চাই।’
আমরা সবাই জানি- বৃন্দাবন দাস নাটকের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। অবশ্য এ নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনাও করেন। তবে বৃন্দাবন দাস বিষয়টিকে নিয়ে ভাবছেন না একটুও। তিনি মনে করেন, নাটক জীবনের কথা বলে। সমাজের কথা বলে। ‘আর আমার নাটক সহজ সরল সাধরণ মানুষের গল্প নিয়ে লেখা। শুদ্ধ, বইয়ের ভাষার পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটাই দর্শকদের জানা দরকার। এতে করে আঞ্চলিক ভাষাগুলোও বেঁচে থাকবে। নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হলে শিক্ষিত মানুষ আঞ্চলিক ভাষার উপর আলাদাভাবে দখল রাখতে সক্ষম হবে। এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই নেওয়া উচিৎ’-বলেন ‘গল্পের জাদুকর’ বৃন্দাবন।
তবে যে যাই বলুক, এই কলমযোদ্ধা বাংলা নাটককে উচ্চ এবং মধ্যবিত্তদের ড্রয়িংরুম থেকে টেনে বের করে এনেছেন। নিয়ে গেছেন গ্রামীণ পটভূমিতে। কাহিনীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রান্তিক মানুষদের কথা ও জীবন। সমাজের অসংগতিগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও সামাজিক কুসংস্কারগুলো হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেন। মোহর শেখ ও হাড় কিপটে নাটক দুটি তার প্রমাণ।
বৃন্দাবন দাসের নাটক মানে চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, মোশাররফ করিমসহ কয়েকজন হাতে গোনা অভিনেতা-এই অভিযোগ কারো কারো। এ বিষয়ে বৃন্দাবন দাস বলেন, কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। আমার নাটকে অনেকেই অভিনয় করছেন। নতুনদের মধ্যেও অনেকে এখন আমার নাটকে অভিনয় করেন। তবে এটাও ঠিক যে ভাষার কারণে অনেকে চাইলেও করতে পারেন না। যারা নাটকের ভাষা বোঝে তাদেরকে নিয়েই নির্মাতারা নাটক তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে চঞ্চল, হাসানরা খুব সহজে আমার নাটকের ভাষা বোঝে আর অভিনয়টাও ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারে। দর্শকও আনন্দ পায়। তাই তাদের নিয়েই বেশি কাজ হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবনে বৃন্দাবন দাস বিয়ে করেছেন টিভি অভিনেত্রী শাহনাজ কবির খুশীকে। দুজন দুজনকে ভালোবেসে ১৯৯৪ সালের ১৯ জানুয়ারি বিয়ে করেন। তাদের দুটি জমজ সন্তান রয়েছে। নাম দিব্য জ্যোতি ও সৌম্য জ্যোতি। স্ত্রী খুশি এখনও নিয়মিত অভিনয় করছেন। তবে সন্তানদের লালন পালন বাদ রেখে নয়। পরিবার সামলে তবেই তিনি অভিনয়ে সময় দেন। সন্তানদের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে বাজার করাটাও খুশির দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কারণ স্বামী বৃন্দাবন গল্প নিয়ে ভাবনার ঘরে ঢুবে থাকেন সারাক্ষণ। তাই তাঁকে সাংসারিক ঝামেলা থেকে চিন্তামুক্ত রাখতে সংসারের এই দায়িত্বটুকু নিজের কাধেই নিয়েছেন খুশি।
এ বিষয়ে বৃন্দাবন বলেন, আসলে খুশি যে নাটক নিয়ে শুটিং নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকে, তা কিন্তু নয়। ওর প্রধান কাজ সংসার সামলানো। সন্তানদের বেড়ে ওঠার পেছনে ওর অবদানেই বেশি। তবে ওর নাটক চ্যানেলগুলো একাধিকবার একাধিক সময়ে প্রচার করে বলেই মনে হয় সে অনেক নাটকে কাজ করছে। ‘খুশি যখন শুটিং এ যায় তখনও একটু পরপর ফোন দিয়ে খবর নেয় আমরা কে কি করছি! ও আসলে সংসারকে বেশি প্রাধান্য দেয়’-যোগ করেন বৃন্দাবন।
বৃন্দাবন-খুশির সংসার আলোচিত করে আছে দিব্য ও সৌম্য। সম্প্রতি তারা দুই ভাইও অভিনয় করেছে বাবার লেখা নাটকে। তাহলে সন্তানরাও কি বাবা-মায়ের পথে হাঁটছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বৃন্দাবন দাস বলেন, সন্তানদের ব্যাপারে আমাদের কোনো চাপ নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের লক্ষ্য স্থির করবে। ওরা কিছুদিন হলো ‘ও’ লেভেল শেষ করেছে। পরীক্ষা শেষে স্কুল ছুটি ছিলো। তাই ওদের ইচ্ছাতেই অভিনয় করেছে। আসলে এখন ওরা লেখা পড়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
নাট্যকার বৃন্দাবন দাস ৭ ডিসেম্বর, পাবনার চাটমোহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম দয়াল কৃষ্ণ দাস। মায়ের নাম ময়না রানী দাস। বৃন্দাবন দাসের শিক্ষাজীবন কাটে মির্জা ওয়াহেদ হোসেন প্রতিষ্ঠিত শালিখা প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে। চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন।
বৃন্দাবন দাসের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- বন্ধুবরেষু, মানিক চোর, বিয়ের ফুল, গরু চোর, টকশো, হাড় কিপটে, পত্র মিতালী, সার্ভিস হোল্ডার, ঘরকুটুম, পাত্রী চাই, তিন গেদা, আলতা সুন্দরী, ভালবাসার তিন কাল, সম্পত্তি, সম্পর্ক, উট, সাকিন সারিসুরি, মোহর শেখ, কথা দিল্যেম তো, লেখক শ্রী নারায়ন চন্দ্র দাস ইত্যাদিসহ প্রায় দুইশতাধিক নাটক ও ধারাবাহিক।
বৃন্দাবন দাস বর্তমানে বেশি ধারাবাহিক নাটকই লিখছেন। তবে বিশেষ বিশেষ দিবস বা ঈদের জন্য কিছু প্যাকেজ নাটক লিখেন। এমনটাই জানালেন তিনি। ভবিষ্যতে আরও সৃষ্টিশীল কাজ উপহার দেওয়ার প্রত্যাশী বৃন্দাবন।
//এআর