লোকজ সংস্কৃতি দিয়ে মাদক জয়
প্রকাশিত : ০৭:০৩ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার
নাটক, পালা গান, থিয়েটার আর লোকজ সংস্কৃতি যে সমাজের অন্ধকার ভেদ করে আলোকবর্তিকা নিয়ে আসতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ময়মনসিংহের অন্বেষা থিয়েটার। মাদক, ইভটিজিং, বখাটেপনা থেকে উঠতি তরুণদের বের করে এনে সমাজের কল্যাণের পথে ধাবিত করছে। সংগঠনটি এলাকার শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও সচেতন তরুণদের পাশাপাশি সম্পৃক্ত করেছে নারীদেরও। তরুণ-যুবক-মধ্যবয়সীসহ কেওয়াটখালির নানা বয়সী মানুষকে এক সুঁতোয় বেধেছে সংস্কৃতি দিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী একটা সময় মাদকাসক্ত, বখাটে ও নেশাগ্রস্থদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তরুণ প্রজন্মকে মাদক ও অপরাধ জগত থেকে বের করে আলোর পথে আনতে উদ্যোগী হন এলাকার কিছু সংস্কৃতিমনা তরুণ। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন তরুণ নাট্যকর্মী সায়িক সিদ্দিকী। তিনি নাটক, পালা গান ও লোকজ সংস্কৃতি দিয়ে মাদকের ছোবল থেকে উঠতি বয়সী ছেলেদের বের করে আনার প্রত্যয় গ্রহণ করেন। গড়ে তোলেন সংস্কৃতি চর্চার প্লাটফর্ম অন্বেষা থিয়েটার। দীর্ঘচেষ্টার পর লোকজ সংস্কৃতি দিয়ে মাদক জয় করতে সক্ষম হন তারা। বর্তমানে পাল্টেছে কেওয়াটখালী গ্রামের চিত্র, বদলেছে এর দৃশ্যপট। অন্বেষা থিয়েটার ভবনটি এখন নাট্যচর্চার এক মহালয়ে পরিণত হয়েছে। মাদক, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, জঙ্গিবাদ ও যত্রতত্র বর্জ্য ফেলাসহ সব ধরনের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে এলাকায় ব্যাপক জনসচেতনতা সৃ্ষ্টিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অন্বেষা থিয়েটারের কর্মীরা।
অন্বেষার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেওয়াটখালী এলাকায় রেলওয়ে কলোনীর পরিত্যাক্ত একটি ভবনে ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গুটি কয়েক শিক্ষার্থীর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ‘অন্বেষা’ । বর্তমানে অন্বেষায় পঞ্চাশেরও বেশি সংস্কৃতিকর্মী রয়েছে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।
অন্বেষা নামকরণের পটভূমির কথা জানিয়ে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা তরুণ নাট্যকর্মী সায়িক সিদ্দিকী একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)অনলাইনকে বলেন, ১৯৭২ সালে ক্রীড়াচক্রের জন্য থিয়েটার ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ দুটি ঐতিহাসিক জাতীয় দিবসে শিশুদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। একটা সময় ভবনটি মাদকসেবীদের দখলে চলে যায়। ক্রীড়া-সংস্কৃতির বদলে শুরু হয় মাদকসেবনসহ নানা অপকর্ম। মাদকের ছোবল থেকে তরুণদের বের করে আনতে আমরা উদ্যোগী হই। ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভবনটি পুনরুদ্ধার করি। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় অন্ধকার থেকে তরুণ প্রজন্মকে বের করে আনার সংগ্রাম।
সায়িক সিদ্দিকী ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় আরও জানান, ২০১৫ সালে একুশের প্রথম প্রহরে আমরা অন্বেষা প্রতিষ্ঠা করি। এরপর মঞ্চস্থ করি লোকজ নাটক ‘গুলেজান-গুলেজা’ । সেদিন থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি । যেখানে গিয়েছি, পেয়েছি আতিথেয়তা, পেয়েছি গ্রহণযোগ্যতা । শুধু তাই নয়, সম্পৃক্ত করতে পেরেছি এলাকার নারীসহ অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে ।
অন্বেষা প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকের কথা জানিয়ে তরুণ এই নাট্যকর্মী বলেন, অন্বেষা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই এলাকার নারী। প্রথমদিকে মঞ্চটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হলেও বর্তমানে এর মঞ্চ, কক্ষের দরজা-জানালা ও আসবাব আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে । মঞ্চের অর্থায়নে সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেলেও কেওয়াটখালির খেটে খাওয়া মানুষজন নিজেদের অর্থায়নে মঞ্চটিকে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
তবে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রায় অবদান রাখছেন বলেও তিনি জানান । ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার অন্বেষার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এক লাখ টাকা স্পন্সরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
অন্বেষার বর্তমান অগ্রগতির কথা জানিয়ে সায়িক সিদ্দিকী বলেন, অন্বেষার সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমসাময়িক বিষয়গুলি নিয়ে লোকজ নাটক করে থাকে । অন্বেষার জনপ্রিয় নাটক ’গুলেজান গুলেজা’ নিয়ে তিনি বলেন, ফেসবুক আসক্তি ও সিরিয়াল এ দুটির সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে নাটকটি তৈরি করা হয়েছে। নাটকটির দুটি চরিত্রে একটিতে মা, যিনি সিরিয়ালে আসক্ত; অপরটি হলো মেয়ে যিনি ফেসবুকে আসক্ত। গুলেজান আক্তার গুলেজা থেকে ফেসবুকে গুলেজান গুলেজা হয়ে উঠার পরিণতি ও মায়ের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টির কাহিনী নাটকটিতে প্রাঞ্জলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মেয়ের ফেসবুক আসক্তি কমাতে মুঠোফোন ব্যবহারের উপর মায়ের নিষেধাজ্ঞা ও তার বিপরীতে মেয়ের বিদ্রোহী আচরণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে নাটকটিতে। নাটকটিতে দেখা যায়, মা যখন মেয়েকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করেন, বিপরীতে মেয়ে গুলেজান মাকে সিরিয়াল দেখা বন্ধ করার পরামর্শ দেন । গুলেজান মাকে জিজ্ঞেস করেন, ’তুমি কি আমাকে তোমার সিরিয়াল ফেলে সময় দিয়েছো যে, আমি পড়াশোনা করবো’ । মূলত এভাবেই এগিয়ে চলে নাটকটি ।
বর্তমানে সংগঠনটি রোহিঙ্গা ইস্যু, মাদক বিরোধী প্রচারণাসহ বিভিন্ন সামাজিক নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছে । গুলেজান থেকে অদ্যাবধি যত নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে সেগুলোর কলাকুশলীদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন এলাকার নারীরা। নিজেদের ঘরের চাল-ডাল-সবজি দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। এতে করে সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিতে নারীর অংশগ্রহণও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অন্বেষার প্রতিষ্ঠাতা। এলাকার নারীদের দেওয়া চাল-ডাল-সবজি-তেলে তৈরি করা ’সিন্নি’(খিচুরি) খাওয়ার নিমন্ত্রন দিয়ে তিনি সবাইকে অন্বেষা থিয়েটারে আসার আমন্ত্রন জানান ।
//এআর