জীবন সংগ্রাম
কাজের সন্ধানে ৭ দিন ধরে নীলক্ষেত মোড়ে বিমল
ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ২ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার
বিমল চন্দ্র হাওলাদার। ভিক্ষাবৃত্তি নয় কাজ করতে চান। কাজ দিয়েই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে চান।
বিমল চন্দ্র হাওলাদার (৫২)। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার মুরাদিয়া গ্রামে। কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসা। একসময় নীলক্ষেত বাকুশাহ মার্কেটে তার ফার্নিচারের দোকান ছিল। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে দরজা, জানালা, খাটসহ আসবাব তৈরির অর্ডার আসত তার দোকানে। একা সামাল দিতে না পেরে দোকানে দু’জন লেবারও খাটাতেন বিমল। দোকান থেকে যা আয় হত তা দিয়ে দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে সংসার ভালোই কাটছিল এ কাঠমিস্ত্রীর।
কিন্তু হঠাৎ করে তার বাবা অসুস্থ হওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসা করানো আর পরিবারের ৫ সদস্যের ভরন পোষন করানোর খরচ যোগাতে হিমশিম খেয়ে বসেন বিমল। ছোট্ট দোকান থেকে আসা আয় দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার মিটাতে না পেরে ২০১১ সালের মাঝামাঝি ঢাকার মায়া ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন বিমল।
শহর হোক আর গ্রাম হোক, জীবনযুদ্ধ তো চালিয়ে যেতে হবে। তাই বসে না থেকে নেমে পড়েন কাজে। গ্রামে দিনভর কাঠমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় হতো তা দিয়ে খুব কষ্টে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন বিমল। এরইমধ্যে অর্শ্ব রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন বিমল। তাই রিকশা চালানোসহ রোদ-বৃষ্টি গায়ে মাখার কাজগুলো করতে পারেন না বিমল।
এখন গ্রামে তার করার মত কোনো কাজ নাই। এদিকে ছোট মেয়েটি আবার বাণিজ্য ব্যবসায় শাখা থেকে এইচএসসি পাশ করেছে। চড়া দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে সংসারের খরচ অন্যদিকে মেয়ের পড়া-লেখার ব্যয়ভার বহন করা তার জন্য আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। কোনো দিশা না পেয়ে ফের ঢাকায় আসেন বিমল। উদ্দেশ্য যদি কোনো একটা কাজ মেলে। এরইমধ্যে দিন কয়েক হলো ছেলে একটা কোম্পানিতে সিকিউরিটির কাজ পেয়ে গেছে, তবে তার বেতন ধার্য করেনি কোম্পানী। ছেলের একার আয়ে যে সংসার চলবে না, সেটি বুঝতে পারছেন বিমল। তাছাড়া ছেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে থাকতে চান না কর্মঠ বিমল। সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে কাজের সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কাজ মিলছে না।
বিমল চন্দ্র কাজের আশায় রোজ ভোর ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নীলক্ষেত মোড়ের ঠিক বিপরীতে নিউমার্কেটে যাওয়ার পথে পুলিশ বক্সের কাছাকাছি বসে থাকেন। বসে থাকেন আর মনে মনে ভাবেন এই বুঝি কেউ এসে একটা কাজের কথা বলবেন। আর তিনি কাজে লেগে যাবেন। এই আশায় ৭টা দিন কেটে গেছে, কিন্তু কেউ কাজের কথা বলেনি বিমলকে। তবে আশা ছাড়েননি। জীবনযুদ্ধে যে অত সহজে পরাজিত হতে চান না বিমল।
এ প্রতিবেদককে বিমল বলেন, ‘কাজের সন্ধানে আমি গত সপ্তাহে ঢাকায় এসেছি। এখনও কোনো কাজ পাইনি, কাজ পেলে আমি আমার ছোট মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে পড়ালেখা করাতে পারব। সে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এবার জিপিএ-৪ পেয়ে পাশ করেছে। প্রিয়াঙ্কা বরিশাল বিএম কলেজে অনার্সে ভর্তির জন্য ফর্ম তুলেছে। তার লেখাপড়া নির্বিঘ্ন রাখতে একটা কাজ চান বিমল।
বিমল জানান, তিনি কারো সাহায্য নিবেন না। ঈশ্বর তাকে দু-হাত দিয়েছেন, শরীরে শক্তি দিয়েছেন। তাই কারো কাছে হাত পাতবেন না। কাজ করতে চান। তার বিশ্বাস যে কোনো উপায়ে একটা কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
এ ক’দিন কী খেয়েছেন, কোথায় থাকছেন-জানতে চাইলে বিমল বলেন, ‘তিনদিন আগে পূর্বপরিচিত এক মানুষ জোর করে তাকে ১শ’ টাকা দেন। কাজ পেলে সেই টাকা ফেরত নিতে তাকে অনুরোধ করবো। ওই টাকাটা দিয়েই দিনে একবেলা খেয়ে আছি। রাতের বেলায় মার্কেটের ভেতর ফাঁকা জায়গায় ঘুমাই। মার্কেটে যেহেতু আমার আগে দোকান ছিল তাই কেউ বাধা দেয়না, সবার পরিচিত আমি।’
বিমল এক পোশাকেই কাটিয়ে দিয়েছেন কয়েকটা দিন। কাজ না পেলে হয়তো এভাবে আর কতদিন থাকতে হবে সেটি স্রষ্টা-ই জানেন। তবুও ভিক্ষা করবেন না বিমল। কাজ করবেন।
বিমলের বয়স চলে যাচ্ছে, চেহারায় পড়েছে বার্ধ্যকের ছাপ। তবুও স্বপ্ন দেখেন পরিবারের জন্য ভালো কিছু করার। বিমল চান শত কষ্ট সহ্য করে হলেও মেয়েকে পড়ালেখা করাবেন। মেয়ে গ্রাজুয়েট হতে পারলে তার সব কষ্ট সার্থক।
পাঠক, এভাবে বিমলের মতো আরও বহু লোক কাজের আশায় বসে থাকেন দিনের পর দিন ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে। তারা ভিক্ষাবৃত্তি নয়, কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। সেই সেই ইচ্ছা কি পূরণ হওয়ার নয়?
//এআর