ঠ্যাঙ্গারচরের মালিকানা পেতে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী সন্দ্বীপবাসীর
প্রকাশিত : ০৭:১৪ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার
চট্টগ্রামে সন্দ্বীপের সীমানা ঘিরে জেগে ওঠা ঠ্যাঙ্গারচরের (ভাসানচর) মালিকানার দাবিতে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এলাকাবাসী। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় ভূমি রক্ষা পরিষদ। এ সময় সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সন্দ্বীপে জেগে ওঠা ভূমি রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক লায়ন মিজানুর রহমান। এ সময় সারিকাইত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফকরুল ইসলাম, মগধরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আনোয়ার, আজিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ, উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আবুল হোসেন, সহসভাপতি কাজী ফসিউল আলম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রেজাউল করিম বাবুল, যুবলীগের সভাপতি ছিদ্দিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমান, বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আনোয়ার হিরণ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মিজানুর রহমান বলেন, ঠ্যাঙ্গারচর সন্দ্বীপের পাশে জেগে ওঠা একটি চর হলেও চরটি নোয়াখালীর বলে দাবি করা হচ্ছে। বন বিভাগসহ সরকারি একাধিক সংস্থার জরিপে সন্দ্বীপের মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে জেগে ওঠা চরটি সন্দ্বীপের আদি ইউনিয়ন ন্যায়ামস্তির অংশ। কিন্তু নানা কারণে সন্দ্বীপবাসীর দাবি না মেনে নোয়াখালী জেলার আওতাভুক্ত করা হয়েছে এটি। সন্দ্বীপের আপামর জনগণ অন্যায় এ দাবি কোনোভাবে মেনে নিচ্ছে না। মানববন্ধন সমাবেশের পাশাপাশি চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সন্দ্বীপবাসী তাদের হিস্যা বুঝে নিতে বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবে বলে জানান তিনি।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রাচীন জনপদ সন্দ্বীপের মোট মৌজা ছিল ৬০টি। কিন্তু মেঘনার ভাঙনে বর্তমানে ৩৮টি মৌজা অবশিষ্ট আছে। সন্দ্বীপের ১৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ন্যায়ামস্তি, ইজ্জতপুর, কাটগড়, বাটাজোড়াসহ চারটি ইউনিয়ন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া সারিকাইত, মাইটভাঙ্গা, মুছাপুর, আজিমপুর, রহমতপুর, হরিশপুর, কালাপানিয়া ইউনিয়নের আংশিক অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একসময় সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন মৌজা ন্যায়ামস্তি ১৯৫৩ সাল থেকে নদীভাঙনের কবলে পড়তে থাকে। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মৌজাটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়।
চরের মালিকানার দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন শেষে সংবাদ সম্মেলন থেকেও জেগে ওঠা চরটিকে সন্দ্বীপের অংশ ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
এদিকে স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপকালে তারা বলেছেন, তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে ছিল ন্যায়ামস্তিতে। যা আজকের ঠেঙ্গারচর। তাই জেগে ওঠা চরের মালিক তারাই। দৈনিক আজাদীর সঙ্গে কথা হয় প্রায় সত্তরোর্ধ লিয়াকত আলীর সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সত্তরের দশকে আমাদের আগে বাপ–দাদারা ওই চরে বসবাস করতেন। সেই চরটি আজ অন্যায়ভাবে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। কোথায় যাবো আমরা। আমাদের প্রাণের দাবি এ চরকে রক্ষা করবোই।
গতকাল অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোক অংশ নেন। এসব ব্যানারে লেখা ছিল, ‘মানবতার মা শেখ হাসিনা, ভাসানচর (ঠ্যাংগার চর) হাতিয়ার না’ ‘প্রয়োজনে রক্ত দেব, ভূমির অধিকার ছাড়বো না’ ‘ঠ্যাংগার চরের ঠিকানা দাদা–পিজার ঠিকানা’ ‘বাপদাদার ভিটে চর সন্দ্বীপবাসী রক্ষা কর’ বাস্তবায়ন হোক বিএস জরিপের, ঠ্যাংগারচর (ভাসানচর) সন্দ্বীপের’ রক্ত দেবো, ‘তবুও মাটি দেবো না’ দাদার ভিটা চর সন্দ্বীপবাসী রক্ষা কর’, ‘রক্ত দেব, মাটি দেব না’। মানববন্ধনে অংশ নেন স্থানীয় একটি স্কুলের ছাত্রী সাদিয়া। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার দাদার কাছে ঠেঙ্গারচরের গল্প শুনেছি। চরটি আমাদের। এখন সন্দ্বীপের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই জেগে ওঠা চরে সন্দ্বীপবাসীকেই ঠাঁই দিতে হবে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপকাল জানা গেছে, বাংলাদেশের মূলভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রাচীন জনপদ সন্দ্বীপের মোট মৌজা ছিল ৬০টি। কিন্তু মেঘনার ভাঙনে বর্তমানে ৩৮টি মৌজা অবশিষ্ট রয়েছে। সন্দ্বীপের ১৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ন্যায়ামস্তি, ইজ্জতপুর, কাটগড়, বাটাজোড়া সহ ৪টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া সারিকাইত, মাইটভাঙ্গা, মুছাপুর, আজিমপুর, রহমতপুর, হরিশপুর, কালাপানিয়া ইউনিয়নের আংশিক অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এক সময় সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন মৌজা ন্যায়ামস্তি ১৯৫৩ সাল থেকে নদী ভাঙনের কবলে পড়তে থাকে। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মৌজাটি সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়।
এদিকে জেগে ওঠা ঠেঙ্গারচরকে সন্দ্বীপের সাবেক ন্যায়ামস্তির অংশ হিসেবে সন্দ্বীপ রেঞ্জের আওতায় বনায়ন করা হয়। ২০১৪ সালের ৬ জুন ন্যায়ামস্তি সন্দ্বীপ মৌজায় জেগে ওঠা চরভূমির ৭শ’ একরজমি বনায়নের জন্য উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষে ৪ ও ৬ ধারার গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে গত ২২ মার্চ চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন বিভাগীয় কমিশনারকে একটি প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, ঠেঙ্গারচরকে সন্দ্বীপের সাবেক ন্যায়ামস্তির অংশ হিসেবে সন্দ্বীপ রেঞ্জের আওতায় বনায়ন করা হয়। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বনায়নের জন্য উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষে গেজেট প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে উক্ত জমির সীমানা বা স্বত্ত্ব ঘোষণার ব্যাপারে কোনো পক্ষ কোন দাবি দাখিল করেনি। সন্দ্বীপের রেঞ্জ কর্মকর্তারা বিগত ১০ বছর ধরে ন্যায়ামস্তি চরে (ভাসানচর) বৃক্ষরোপণ করে আসছেন। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় এক হাজার ৫০ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়।
এদিকে ঠেঙ্গারচরের মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরুর পর চরটিকে নোয়াখালীর হাতিয়ার অংশ বলে ঘোষণা করেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে এক অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘পর্যটন শহর কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেখানে তাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি জীবিকাও নিশ্চিত করা হবে।’
এরপর থেকে নোয়াখালীবাসীর পক্ষ থেকেও চরটি তাদের অংশ বলে দাবি করা হয়। তবে তা মানতে নারাজ সন্দ্বীপ বাসী। তারা বলছেন, হাতিয়া থেকে ঠেঙ্গারচরে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। অথচ সন্দ্বীপ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে সময় লাগে আধঘণ্টা।
সারিকাইত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ভূমি রক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব ফকরুল ইসলাম পনির বলেন, সন্দ্বীপের নিকটবর্তী একটি চর দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপের আওতাভুক্ত থাকার পরও হঠাৎ করেই হাতিয়া দ্বীপের অধীনে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত চলছে। সন্দ্বীপের মানুষ অন্যায্য একটি দাবি মেনে নেবে না। প্রয়োজনে ভাসানচরের মালিকানার দাবিতে সন্দ্বীপবাসী বৃহত্তর কর্মসূচি দেবে বলে জানান।
চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বলেন, সকল দলমত নির্বিশেষে এ দাবিতে সন্দ্বীপবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছি। এটি শুধু সন্দ্বীপবাসীর দাবি নয়, এটি চট্টগ্রামবাসীরও দাবি।
এদিকে গতকালকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, ন্যায়ামস্তি ইউনিয়নের চারটি মৌজার মধ্যে সুলতানপুর, কমুলপুর, শরীফপুর ও পাঁচবাড়িয়া’র উল্লেখযোগ্য অংশ গত এক দশক ধরে সন্দ্বীপের দক্ষিণ–পশ্চিম অংশে জেগে ওঠে। স্থানীয়রা এই চরকে ন্যায়ামস্তি চর, ঠেঙ্গারচর অথবা ভাসানচর নামে ডাকতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। ঠেঙ্গারচর বা ভাসান চরটি সন্দ্বীপের অতি নিকটতম হওয়ার পাশাপাশি ভূমি জরিপ, নদী জরিপ, নক্শা ও খতিয়ান অনুযায়ী সন্দ্বীপের বিলীন হওয়া ইউনিয়ন ন্যায়ামস্তি (চর ন্যায়ামস্তি) হিসেবে সন্দ্বীপের মানুষ দাবি করে আসছে।
গতকালের সমাবেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে কাজী আফাজ উদ্দিন হাই স্কুল, খেলাঘর, আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মাইটভাঙ্গা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, মুছাপুর বদিউজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়, লায়ন ফজলুল কাদের ফাউন্ডেশন, চৌকাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সন্দ্বীপ আবাহনী ক্রীড়াচক্র, সরকারি ওমেদা প্রাথমিক বিদ্যালয়, সন্দ্বীপ কারামতিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, সারিকাইত উলুম মাদ্রাসা, সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুল, দক্ষিণ সন্দ্বীপ নারী প্রগতি সংঘ, মাইটভাঙ্গা ইলেভেন স্টার ক্লাব, সারিকাইত মমতাজ উলুম মাদ্রাসা, সাউথ সন্দ্বীপ ডিগ্রি কলেজ, সোনালী সন্দ্বীপ একতা সংঘ, ইচ্ছেশক্তি ক্লাব, ফয়েজুলুম মাদ্রাসা, সন্দ্বীপ ইসলাহুল মুসলেমিন ফাউন্ডেশন।
আরকে/ডব্লিউএন