ভাবসাগরে ডুবিয়ে দেয় ‘মহাজনের নাও’
সোহাগ আশরাফ
প্রকাশিত : ০২:২৭ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০২:২৯ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম আমাদের শিল্পসংস্কৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। করিমের গানে মুগ্ধ হয়নি, ভাবসাগরে ডুব মারেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। এ সাধককে নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। নানাজন নানাভাবে তাঁর কাজের মূল্যায়ন করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাউলকবির মূল্যায়নে প্রতিভাবান লেখক-নাট্যকার শাকুর মজিদও পিছিয়ে থাকেননি।
করিমকে নিয়ে তার উল্লেখযোগ্য দুটি কাজ হচ্ছে- ভাটির পুরুষ ও মহাজনের নাও। করিমের ওপর দীর্ঘ ৭ বছর গবেষণা করে শাকুর মজিদ বানিয়েছেন প্রামাণ্যচিত্র- ভাটির পুরুষ। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছিলো করিমের জীবদ্দশায়। তাঁর দেহাবসানের পর লিখেছেন গীতিনাট্য ‘মহাজনের নাও’। জীবিত করিম এবং লোকান্তরিত করিম- দুইভাবে শাকুর মজিদ ‘বন্দি’করেছেন তাঁকে। ‘মহাজনের নাও’ প্রকৃতপক্ষে একটি মঞ্চনাটক। নাটকটি সুবচন নাট্যসংসদ’র ৩৩তম প্রযোজনা। নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী।
আজ ১৪ অক্টোবর, শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকটি প্রদর্শীত হবে।
নাটকটি শতবারের অধিক মঞ্চ আলোকিত করার পরেও দর্শকদের কাছে এর কদর একটুও কমেনি। বরং কোন কোন দর্শক নাটকটি দেখেছেন বেশ কয়েকবার। এমনই একজন দর্শক ফার্মগেট বিজ্ঞান কলেজের সিনিয়র শিক্ষক ফাতেমা কাশেম। যিনি নাটকটি দেখেছেন ২৫ বার। আজও তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে নাটকটি দেখবেন। এমনটি জানালেন তিনি।
নাটকটি নিয়ে ফাতেমা কাশেম বলেন, ‘আমি নাটকটি ২৫ বার দেখেছি। এখনও আমি নাটকটি দেখার আগ্রহ রাখি। যতবার দেখি ততবারই আমার মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়। বিশেষ করে নাটকে আবদুল করিমের গানগুলো আমাকে ভাবসাগরে ডুবিয়ে দেয়। তাই পরিবার, বন্ধু-বান্ধব যখনই যাকে সঙ্গে পাই তাকে নিয়ে আসি নাটকটি দেখানোর জন্য।’
আসলেই তাই। বাংলা গানের জগতের অপ্রতিরোধ্য কবি শাহ আবদুল করিম। প্রকৃতি, জীবন, মানবিক আবেগ; হাজার বছরের বহমান বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রত্যাবীক্ষক তিনি। বাংলাদেশের গানের জগতে ‘বাউল সম্রাট’ উপাধিপ্রাপ্ত চারণকবি। তাঁকে নিয়ে গীতিকাব্যময়তায় উপস্থাপিত হয়েছে নাটক ‘মহাজনের নাও’। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জীবনদর্শন ও তার কর্মজীবনকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে নাটকটি।
‘বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ’- বন্দনা দিয়ে শুরু এবং শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নাট্যের শেষ। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এরিনা বা চারদিকের খোলা মঞ্চে প্রদর্শীত হয় নাটকটি। যা ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে ব্যপক প্রশংসা লাভ করেছে।
বাঙালি জীবনের সংস্কৃতির বহমান ‘পালা’ রীতি অবলম্বনে নাট্যটি প্রদর্শিত হয়। এরিনা মঞ্চে গানের মধ্য দিয়ে শাহ আবদুল করিমের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাহিনিবর্ণন নাট্য-উপস্থাপনাটির মূল বিষয়। ‘মহাজনের নাও’ নাটকের বর্ণনা ও সংলাপগুলো ছন্দোবদ্ধ। পালা পরিবেশনারীতির নিয়মতান্ত্রিকতা মানা হয়েছে নাটকটিতে।
সুবচন নাট্য সংসদের এ নাটকটি মূলত দেহতত্ত্বনির্ভর। এতে গানের মানুষ আবদুল করিমের জীবন ও জীবনদর্শন প্রকাশিত হয়েছে গীতল ভাষায়। পুঁথির ঢঙে পয়ার ছন্দ ব্যবহার করে নাটকটি নিবেদন করেছেন কথাশিল্পী শাকুর মজিদ।
যেখানে করিমের জীবনের নানা জটিলতা, সংকট এবং তার থেকে উত্তরণের বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে। ব্রিটিশ শাসনকালে জন্ম এ শিল্পীর। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সংগ্রামময় জীবনে শিল্পী নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। সাধনা করে গেছেন আমৃত্যু।
শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্চের ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। তার গানে তিনি নৌকা শব্দটি অনেকবার ব্যবহার করেছিলেন। অভিনেতাদের দক্ষতায় একজন সহজাত শিল্পীর জীবনবোধ ও দর্শন দর্শককে নিয়ে যায় অন্য জগতে। করিম নিজেকে ভেবেছিলেন যেন কোনো এক মহাজনের কাছ থেকে ধার পাওয়া এক নৌকা। যে নৌকার মালিক তিনি নন। শাহ্ আব্দুল করিমের জীবনকে নাটকের মাধ্যমে তুলে আনতে নাট্যকারকে তার গান নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকেই যেন তার গান আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে ধরা দেয়।
শাহ্ আব্দুল করিম তার সারাটি জীবন মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন তার গানের মাধ্যমে। তার গানে প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে শ্রেণিসংগ্রামের কথা; সাধারণ মানুষের দৈন্যতার কথা। শোষক শ্রেণি যে সবসময় আমাদের দমিয়ে রাখতে চায়, আর সেখানে যে শিল্পী শ্রেণি শুধু তাদের কাছে ব্যবহূত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে তারও প্রমাণ বাউল শাহ্ আব্দুল করিম নিজেই। তাকেও কয়েকটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু তার যথাযোগ্য সম্মান বা সম্মানী কোনোটাই তাকে দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দলের নেতারা যে শিল্পীদেরকে শুধু তাদের প্রয়োজনেই ব্যবহার করে, সে কথা নাটকে শাহ্ আব্দুল করিমের মুখেই উঠে আসে।
কোন মিস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় … এই গানের সুরে সুরে একসময় বিদায় নেয় ‘মহাজনের নাও’।
নাটকটির বিশেষত্ব হচ্ছে, সুবচন নাট্য সংসদের সকল অভিনয়শিল্পীই একেক জন গানেরও শিল্পী। গান ও অভিনয়ে তারা মুগ্ধ করেন দর্শকের মন।
মহাজনের নাও নাট্যটি প্রযোজনায় বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কুশলী – চরিত্রাভিনয়ে : করিম – ফজলুল হক রাসেল, ইমরান হোসেন, রূপা নাসরিন, মেহেদী হাসান সোহাগ, আহাম্মেদ গিয়াস, আমিরুল ইসলাম বাবুল, ইমাম : আসাদুল ইসলাম আসাদ, আনসার আলী, ডিসি : আনসার আলী/ সাইফুল ইমাম দিপু/ মনিরুল হোসেন শিপন, ইউএনও : রফিক, রুহি : তানভীর আহম্মেদ, আকবর : রনি আলম লিমন, সুনন্দ : প্রশ্ন, সরলা : তাসলিনা হক লিনা, রূপা নাসরিন/ সোনিয়া হাসান সুবর্ণা, সাত্তার মিয়া : লিঠু রানী মন্ডল, আবদুর রহমান : আমিরুল ইসলাম বাবুল।
গায়েন ও কথক – আমিরুল ইসলাম বাবুল, আহাম্মেদ গিয়াস, রূপা নাসরিন, ইমতিয়াজ, লিঠু রানী মন্ডল, ফজলুল হক রাসেল, ইমরান হোসেন, মেহেদী হাসান সোহাগ, সোহেল খান, শাহ সালাউদ্দিন, তানভীর আহমেদ, সাঈদ বাবু, আসাদুল ইসলাম আসাদ।
গীতিতে – তানভীর আহমেদ ভুঁইয়া, সোহেল খান, শাহ সালাউদ্দিন, মেহেদী হাসান তাসলিনা হক লিনা, পান্থ, সম্ভব, পাভেল, নোবেল, তানিম, প্রশ্ন, রফিক, আনসার আলী, আসাদুল ইসলাম আসাদ, সাঈদ বাবু, রনি আলম লিমন, শ্রীনিবাস দাস।
নেপথ্যে – আলো, মঞ্চ, পোশাক ও দ্রব্য : সুদীপ চক্রবর্তী, আবহসংগীত : আহসান হাবীব নাসিম, পোস্টার ও প্রচ্ছদ : সাইফুল, ইমাম দিপু, মুখোশ : শ্যামল সরকার, আলোক পরিকল্পনা সহযোগ : গর্গ আমিন, পোশাক পরিকল্পনা সহযোগ : কাজী তামান্না, সৈয়দা ইফাত আরা, সুশান্ত সরকার, রনি আলম লিমন, পোশাক নির্মাণ : আরিফ, দ্রব্য পরিকল্পনা সহযোগ : সোহেল খান, পাভেল, মুনিম তরফদার, বেলাল মিয়া, আবহসংগীত সহযোগ : ইমতিয়াজ, বাদ্যযন্ত্র সমন্বয় : ইমতিয়াজ, রংপট অঙ্কন : রঘুনাথ চক্রবর্তী, বাউল করিমের গান ও সুর প্রশিক্ষণ : বাউল আবদুর রহমান ও শাহ আবদুল তোয়াহিদ, সহযোগ : দোলন, লাঠি খেলা প্রশিক্ষণ : আবদুল হেলিম বয়াতী ও তাঁর দল (নেত্রকোনা), মঞ্চ ব্যবস্থাপনা : সোহেল খান, প্রচার ও প্রকাশনা : সাইফুল ইমাম দিপু, বিশেষ সহযোগিতা : ড. ইস্রাফিল শাহীন, প্রযোজনা অধিকর্তা : আহাম্মেদ গিয়াস।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ‘মহাজনের নাও’ নাটকটি মঞ্চে নিয়ে আসে সুবচন নাট্য সংসদ। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় দুটি প্রদর্শনী ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, জলপাইগুড়ি, অসম, কলকাতা, লন্ডন ও বাংলাদেশের কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাজশাহী, সিলেট, সাভার, বিয়ানীবাজার, বরিশালসহ আরও অনেক জায়গায় সফল প্রদর্শনী হয়েছে।
//এআর