হৃদয়ের কথা পর্ব-৯
হৃদরোগের কারণ
প্রকাশিত : ০২:৪৩ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার
আমাদের দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিণ্ড । বুকের মাঝখানে দুই ফুসফুসের মাঝে এটি অবস্থিত। এর রয়েছে চারটি প্রকোষ্ঠ। ওপরের দুটিকে বলা হয় অ্যাট্রিয়াম বা অলিন্দ এবং নিচের দুটিকে বলা হয় ভেন্ট্রিকল বা নিলয়। আর হৃৎপিণ্ড তার চারপাশে পেরিকার্ডিয়াম নামক একটি আবরণী দ্বারা পরিবেষ্টিত।
হৃৎপিণ্ডকে আমরা বলতে পারি, এটি একটি পাম্প যা একজন মানুষের জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে চার কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষবার হৃৎস্পন্দনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড দেহের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে । আর এটি সম্ভব হচ্ছে ধমনী শিরা উপশিরা ও ছোট ছোট রক্তনালী মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজার মাইল পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে ।
কেউ কেউ মনে করেন,হৃদয় আর হৃৎপিণ্ড একই জিনিস;কিন্তু আসলে তা নয় । হৃৎপিণ্ড সম্পর্কে বলা যায়,এটি একটি মাংসপিণ্ড আর হৃদয় হচ্ছে একটি চেতনাগিত অস্তিত্ব-যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না; তবে এটি আমাদের অনুভূতিতে সাড়া দেয় ও প্রভাবিত হয় ।
আমরা জেনেছি,পাম্প করে সারা শরীরে রক্ত পাঠানোই হৃৎপিণ্ডের অন্যতম প্রধান কাজ । কিন্তু মজার ব্যাপার হলো,হৃৎপিণ্ডের নিজের কোষ ও পেশিগুলোর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং কর্মক্ষম থাকার জন্যেও দরকার পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি । এ পুষ্টি পৌঁছে দেয়ার কাজটি সাধিত হয় রক্তের মাধ্যমে । হৃৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে করোনারি ধমনী । হৃৎপিণ্ডের প্রধান দুটি করোনারি ধমনী হলো,যথাক্রামে বাম ও ডান করোনারি ধমনী বা লেফট করোনারি আর্টারি ও রাইট করোনারি আর্টারি ।লেফট করোনারি আর্টারি আবার একটিু নিচের দিকে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে-লেফট অ্যান্টেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি (েএলএডি)ও লেফট সারকামফ্লেক্স আর্টারি (এলসিএক্স)।
করোনারি হৃদরোগ
হৃৎপিণ্ডের অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে । এর মধ্যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে রোগটি সবচেয়ে ভাবনার কারণ হযে দাঁয়িয়েছে সেটি হলো,করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary artery disease)।
ভুল জীবনযাপনের ফলে করোনারি ধমনীর ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল প্লাক বা হলুদ চর্বির স্তর জমে । এতে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় ।
যার করণে হৃৎপিণ্ডের কোষগুলোতে রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে না । ফলে রোগী একসময় বুকে ব্যাথা অনুভব করে । রক্ত চলাচল কমে গিয়ে এ সমস্যাটি দেখ দেয় বলে একে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজও বলা হয়ে থাকে ।
করোনারি হৃদরোগজনিত এ ব্যথটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এনজাইনা (Angina)নামে পরিচিত। অধিকাংশ রোগীই এ সময় বুকের মধ্যে ভার ভার বা এক ধরনের চাপ অনুভব করেন ।মূলত বুকের বাম দিকে বা বুকের মাধ্যখানে এই ব্যাথা অনুভূত হয় । কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও অনুভব হতে পারে । বুকের এই ব্যথা সাধারণত ঘাড়,থুতনি,ওপরের পিঠ,বাহু ,বিশেষ করে বাম হাত বা কব্জিতেও ছড়িয়ে যেতে পারে । কখনো কখনো ওপরের পেটেও এ ব্যথা হতে পারে,যা সবচেয়ে বিপজ্জনক ।
মনে হবে এসিডিটি ।রেনিটিডিন বা ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধও হয়তো একটি খেয়ে নিলেন । তবু কমছে না , বরং কিছুটা যেন বাড়ছে । একমসয় দেখা গেল,আপনার হার্ট অ্যাটাক এবং ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে । কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাকের অন্যম চিত্র এটি । অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে আপনি মনে করছেন এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ।
আবার এমনও নয় যে,অরোনারি হৃদরোগ হলে সবসময় আপনার ব্যথা হবে। অনেক রোগী আছেন,যাদের করোনরি ধমনীতে হয়তো ৭০/৮০/৯০শতাংশ ব্লকেজ,কিন্তু কখনোই ব্যথা অনুভব করেন নি । তিনি হয়তো প্রথমবারের মতো ব্যথা অনুভব করেন,যেদিন তার হার্ট অ্যাটাক হয় ।
করোনারি হৃদরোগ মূলত এনজাইনা পেকেটোরিস(Angina Pectoris)ও মায়োকর্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction)এ দু’ধরণের ।
করোনারি ধমনীতে চর্বি জমে ব্লকেজ সৃষ্টি হতে শুরু করলে এর মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল কমে আসে । যার ফলে হৎপিণ্ডের সে নির্দিষ্ট অংশে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ হতে পারে না এবং হৃৎপিণ্ডের কোষগুলো বঞ্চিত হয় প্রয়োজনীয় আক্সিজেন ও পুষ্টি থেকে । তখন বুকে ব্যথা হতে শুরু করে । এটাই এনজাইনা পেকটোরিস ।
আর এই ব্লকেজের পরিমাণ যদি বাড়তে বাড়তে শতভাগ হয়ে যায় এবং ধমনী-পথে রক্ত চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আসে ,তখনই হার্ট অ্যাটাক । চিকিৎসা পরিভাষায় যা মায়োকর্ডিয়াল ইনফার্কশন নামে পরিচিত । রোগী এ সময় বুকে তীব্র ও অসহনীয় ব্যথা অনুভব করেন । এ ব্যথা কখনো কখনো বুক,গলা,ঘাড়,ওপরের পেট,দুই হাত এবং পিঠেও চলে যেতে পারে । সাথে শ্বাসকষ্ট,বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে । রোগী ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং জরুরি চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী,মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা করোনারি হৃদরোগের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি কারণকে বিশেষভাবে চিহিৃত করেছেন ।
বয়স
বিজ্ঞানীরা বলছেন,বয়স যত বাড়তে থাকে হৃদরোগের আশঙ্কাও তত বাড়তে থাকে । আমরা যদি দেখি,হৃদরোগ সাধারণত কোন বয়সে হয় ? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি হয় চল্লিশ বছর বয়সে এসে বা তার পরে।
লিঙ্গভেদে
হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনামূরক বেশি । তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ অর্থাৎ ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়তে থাকে । এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে যারা নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ ওষুধ সেবন করেন,তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জেনেটিক বা বংশগত
বাবা-মায়ের হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদেরও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে । গবেষকদের মতে,এর মূল কারণ হচ্ছে পারিবারিক ভুল খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপানের ইতিহাস । এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,কারণ একজন মানুষ শৈশব থেকে প্রায় সব ব্যাপারই পারিবারিক রীতি ও আচার-ঐতিহ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠে ।
খাদ্যাভ্যাসও চালু থাকে জীবনের শুরু থেকেই মানুষ সাধারণত সেই খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । তাই মূলত পারিবারিক ভুল খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপানই বংশগত হৃদরোগের অন্যতম কারণ ।
ধূমপান
যুক্তরাষ্ট্রের নিনেসোটা ইউনিভর্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেল্থ ও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভর্সিটির এক যৌথ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে,অল্প বয়সেই হার্টের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং হার্টে অ্যাটাকের জন্যে যেসব কারণকে দায়ী করা হয় তার মধ্যে ধূমপান আবস্থান শীর্ষে ।
উচ্চ রক্তচাপ
করোনারি হৃদরোগের একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ । ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় এটি ধমনীর গায়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় চাপ দেয় । আর এই চাপটা যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়,সেটিই উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন ।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে করোনারি ধমনীর ভেতরের অংশে ক্ষতের সৃষ্টি হয় । রক্তের মধ্যে থাকা অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সেই ক্ষতের জায়গাটিতে আটকে যায় । এভাবে রক্ত চলাচলের পথে পরবর্তীতে আরো কোলেস্টরল একটু একটু করে সেই একই জায়গায় জমতে থাকে । যার ফলাফল করোনারি ব্লকেজ ।
রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য
হদরোগের আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য,যার অন্যতম কারণ ভুল খাদ্যাভ্যাস,ধূমপান ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস একটি নীরক ঘাতক । শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরই এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে । হৃৎপিণ্ডও এর ব্যতিক্রম নয় । তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশি । ডায়াবেটিস একাই হৃদরোগের ঝুঁকিস বাড়ায় প্রায় ৩৩ শতাংশ । আর এর সাথে উচ্চ রক্তচাপ যোগ হলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ শতাংশে ।
অতিরিক্ত ওজন এবং মেদস্থুলতা
অতিরিক্ত ওজন যাদের,তাদরে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃৎপিণ্ডকে তুলনামূলক বেশি কাজ করতে হয়।এটিও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় । মূলত খাবার থেকে পাওয়া ক্যালরির পরিমাণ ও এই ক্যালরি ব্যবহারে অসামঞ্জস্যতাই অতিরিক্ত ওজনের কারণ । এটিও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় । মাত্রাতিরিক্ত ওজনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ,কোলেস্টরলের আধিক্য ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায় অনেকগুণ ।
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
আধুনিক ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ জীবনে সবাই আমরা কমবেশি গা ভাসিয়ে দিয়েছি । অথচ শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় ও পরিশ্রমহীন অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত যারা,তাদের অকালমৃত্যু ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্তদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি । তাই হয়তো বলা হয়ে থাকে‘যত আরাম তত ব্যারাম’।
অবশ্য করোনারি হৃদরোগের কারণ আলোচনায় এটাই শেষ কথা নয়;চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও তা-ই বলছে । কারণ,কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়,অতিরিক্ত ওজন,উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস কিংবা মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল –এসব কোন সমস্যাই নেই ,অথচ তিনি করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন । আবার দেখা গেল,৮০ বছর বয়সেও বাবার হৃদযন্ত্র দিব্যি সুস্থ,কিন্তু ছেলের ৪০ না পেরোতেই হার্ট অ্যাটাক ।
এছাড়াও জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি এবং এ থেকে সৃষ্টি স্ট্রেস বা মানসিকি চাপ,যাকে আমরা সহজ ভাষায় বলতে পারি টেনশন । পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এ বিষয়টি আমাদের কাছে ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সূত্র: কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাবের হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ গ্রন্থ থেকে সংকলিত (সংক্ষেপিত)।
//এআর