উপজেলা আদালত জেলা সদরে থাকায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ চরমে
মোহাম্মদ ইউসুফ
প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৬:২৭ পিএম, ১ নভেম্বর ২০১৭ বুধবার
উপজেলা পদ্ধতি পুন:প্রবর্তন করা হলেও উপজেলা আদালত জেলা সদরে থাকায় জনস্বার্থ দারুণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। জনগণের শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলা সদরে নির্মিত আদালত ভবনগুলো পরিত্যক্ত রেখে কার স্বার্থে উপজেলা আদালত জেলা সদরে বহাল রাখা হল তা বোধগম্য নয়। উপজেলা আদালত জেলা সদরে অবস্থানের কারণে মামলা-মোকাদ্দমার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে মফস্বলের বিচার প্রার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার। নানামুখি হয়রানি, সময় ও অর্থের অপচয় তো হচ্ছেই, পাশাপাশি সুবিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই। আইনজীবী, বিচারক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ উপজেলা কোর্ট উপজেলা সদরে রাখার পক্ষপাতি। কেউ কেউ উপজেলা আদালত জেলা সদরে রাখার যুক্তি দেখালেও সার্বিক বিবেচনায় বিচার কার্যক্রম জনগণের দোরগোড়ায় থাকা-ই যুক্তিযুক্ত। উপজেলা আদালত পুনরায় উপজেলার আগের ভবনে চালু করতে নতুন করে কোনো কিছু আয়োজনের প্রয়োজন নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক উপজেলা সদরে বিচার বিভাগ (আদালত) পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিতে পারে অনায়াসে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এরশাদ জনকল্যাণমূলক যে’কটি কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে উপজেলা পদ্ধতি অন্যতম। অবশ্য প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় আনার স্বপ্ন ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বিগত ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়ে এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করে। অবশেষে ১৯৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। উপজেলা কোর্ট নিয়ে যাওয়া হয় জেলা কোর্ট ভবনে। এ ঘটনা সেদিন জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এরশাদ স্বৈরাচার হলেও তার পদক্ষেপ তো (উপজেলা পদ্ধতি) গণমুখিই ছিল। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে সেদিন বিএনপি সরকার এরশাদ প্রবর্তিত উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিএনপি সরকার কর্তৃক বিলুপ্ত উপজেলা পদ্ধতি পুনরায় চালু করে। উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর প্রথম তফসিলের তৃতীয় কলামে থানাকে উপজেলা করা হয়েছে। থানা শব্দের পরিবর্তে উপজেলা শব্দ ব্যবহারের আদেশ জারি করা হয়।
উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে আংশিক; পুরোপুরি নয়। উপজেলা পদ্ধতির অন্যতম দিক, যা জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই বিচার ব্যবস্থা জেলা সদরে বহাল রাখা হয়েছে। উপজেলা সদরে এখন আদালতের কার্যক্রম চালু করা সময়ের দাবী। উপজেলা পর্যায়ে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে এখানে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। আগের সেই আদালভবনগুলো আবার মুখরিত হয়ে ওঠতো জন উপস্থিতিতে। উপজেলা সদরে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলে জনগণ তাদের হাতের কাছেই একজন ম্যাজিস্ট্রেট পেতো। উপজেলা ক্যাম্পাসে ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য নির্ধারিত বাসা আছেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা সদরে ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক। জেলা সদর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আসতে যে সময় লাগে ততক্ষণে ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যায়। ইউএনও’র কাছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকলেও তিনি জনগণের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচিত নন। বর্তমানে ১৬৪ ধারায় আসামীর স্বীকারোক্তি ও ভিকটিমের ডায়িং ডিক্লেরেশনের কাজ সারতে লোকজনকে জেলা কোর্টে ধর্ণা দিতে হয়। পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রের (পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি,ডিগ্রি ও মাদ্রাসা পরীক্ষা) উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু উপজেলা সদরে ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে এ সংকট হতো না।
১৯৮২ সালে দেশে ৪৬০টি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট জেলা সদরে স্থানান্তর করে এবং পরবর্তী সময়ে জেলা সদরে স্থানান্তরিত ‘উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত’ নামটি রহিত করা হয়। তবে বর্তমানে উপকূলীয় ১৫টি উপজেলায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে-কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া (কক্সবাজার), লামা (বান্দরবান), সন্দ্বীপ, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম), হাতিয়া (নোয়াখালী), মনপুরা (ভোলা), কলাপাড়া (পটুয়াখালী), পাইকগাছা, কয়রা (খুলনা), আমতলী, পাথরঘাটা (বরগুনা) জকিগঞ্জ (সিলেট) ও দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)।
এদিকে উপজেলা কোর্ট জেলা সদরে স্থানান্তরিত হওয়ায় বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানির শেষ নেই। আদালত প্রাঙ্গণে লোকজনের ভিড় এতোবশি যে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। বিচারক, আইনজীবী, বাদী-বিবাদী, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় সুষ্ঠু ও নিরিবিলি পরিবেশ বজায় থাকে না। ৩০-৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেশের অনেক উপজেলার লোকজনকে বিচারের আশায় জেলা সদরে আসতে হয়। কোনো কারণে মামলা ধরা না হলে মামলার সাথে সংশ্লিষ্টদের আবার ফিরে আসতে হয় নতুবা জেলা সদরের হোটেলের বাসিন্দা হতে হয়। আর্থিক ক্ষতি, মানসিক যন্ত্রণাসহ নানামুখি ঝামেলায় দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বাদী-বিবাদীদের উপজেলা আদালতে যে মামলা নিষ্পত্তি করতে দেড়-দু’হাজার টাকা লাগতো, বর্তমানে জেলা কোর্টে খরচ হয় ১০ হাজার টাকার ওপরে। তবে জেলা সদরের কোর্টে গিয়ে গ্রামীণ মানুষ যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় তার সমাধান একটাই তাহলো, উপজেলা কোর্ট উপজেলা সদরে স্থানান্তরিত করা। এতে করে সব ল্যাঠা চুকে যায়। উপজেলা কোর্ট উপজেলা সদরে স্থানান্তরে আইনগত কোনো বাধা নেই; প্রয়োজন শুধু সরকারি বিশেষ ঘোষণার।
উপজেলা কোর্ট উপজেলা সদরে স্থানান্তরের পাশাপাশি ঢাকার বাইরে বিশেষ করে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে মামলা-মোকাদ্দমাও বেড়েছে কয়েকগুণ। বেড়েছে মামলার প্রকারভেদও। যেমন- পারিবারিক আদালত, দেউলিয়া আদালত, নারী ও শিশুনির্যাতন প্রতিরোধ আদালত, জননিরাপত্তা আইন আদালত, শ্রম আদালত ইত্যাদি। হাজার হাজার মামলা জেলা সদরের আদালতে স্তূপিকৃত রয়েছে। লাখ লাখ মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে। আমাদের দেশে যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়সহ দেশের প্রত্যন্ত উপজেলা থেকে ঢাকা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা পরিচালনা করা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ এবং সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত। এসব বিষয় বিবেচনা করে দেশের শাসনতন্ত্রে ঢাকা ছাড়া অন্যান্য উপযুক্তস্থানে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার বিধান আছে। সেই লক্ষ্যে হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ে মামলাগুলো সহজে নিষ্পত্তি করতে উপজেলা সদরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ন্যুনতস সময়ে ও কম খরচে উপজেলা কোর্টে বিচারকার্য সুসম্পন্ন হতো। হাইকোর্টের বেঞ্চ চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল. রংপুর ও যশোর- এ ছয়টি স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কোর্ট বসার বিল্ডিং করা হয়, জজদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। একটি রিভিশন মামলা তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয়ে হাইকোর্টে দায়ের করে তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে মামলা নিস্পত্তি হতো। একই মামলা একই জজ এর কাছে হাইকোর্টে করতে গেলে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকা লাগে। ৫-৭দিন ঢাকায় অবস্থান করতে হয় মামলার বাদী-বিবাদীদের। ৫-৭ বছরেও মামলার নিস্পত্তি হয় না। এ পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা কেন্দ্রিক কোর্ট কাছারি স্থাপন এবং রাজধানীর বাইরে অন্তত বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে জনসাধারণকে অযথা হয়রানি, সময় ও আর্থিক অপচয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
বিচার ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও দ্রুত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার লক্ষ্যে উপজেলা কোর্ট উপজেলা সদরে স্থানান্তর করা জরুরি প্রয়োজন। জনস্বার্থকে পাশ কাটিয়ে বিশেষমহলের সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে উপজেলা কোর্টকে জেলা কোর্টভবনে বহাল রাকা কারও কাম্য হতে পারে না। তাই বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দোগোড়ায় এনে বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানি লাঘবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক- প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী