‘বিনোদিনী দাসী’ ও আমাদের শিমূল ইউসুফ
সোহাগ আশরাফ
প্রকাশিত : ০২:২০ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ১২:৫০ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০১৭ সোমবার
নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক বেদনাবিধূর ইতিহাসের নাম। সেই ইতিহাস নিজের অভিনয়ে ধরে রেখেছেন বাংলাদেশের মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফ। অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতপরিচালক, কোরিওগ্রাফার, পোশাক পরিকল্পনাসহ অসংখ্য মনোমুগ্ধকর কাজের কারিগর তিনি। দীর্ঘ একবছর পর ‘বিনোদিনী’ নাটকের মাধ্যমে আবারও মঞ্চে উঠছেন এই মঞ্চ সম্রাজ্ঞী।
আজ ২৯ অক্টোবর, সন্ধ্যা ৭টায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নাটকটি মঞ্চায়ন হবে।
‘বিনোদিনী’ ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম নাটকের একটি। নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন শিমূল ইউসুফ। নাটকটির গবেষণা ও গ্রন্থনায় সাইমন জাকারিয়া, নির্দেশনা উপদেষ্টা অধ্যাপক সেলিম আল দীন, নির্দেশনায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।
নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী যখন প্রতিভার মধ্য গগণে অবস্থান করেছিলেন ঠিক তখনই তিনি ছিটকে পড়েছিলেন অভিনয় জীবন থেকে। এই বিস্ময় নারীর জীবনের পরতে পরতে লেখা আছে বেদনার কাব্যগাথা। তিনি অন্ধকার থেকে আলোতে বের হয়ে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে করেছিলেন বিদ্রোহ। নিজের প্রতিভা এবং কর্মক্ষমতা দিয়েই যে সমাজের নিষ্ঠুরতা অতিক্রম করা যায় না বিনোদিনী দেবী তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের সরাসরি তত্ত্বাবধানে, বাংলার নাট্যমঞ্চে প্রথম শ্রেণীর অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন এই বিস্ময় নারী। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং তৎকালীন নাট্যজগতের সম্ভ্রান্ত আসনে নাট্যাভিনেতাদের সঙ্গে বিনোদিনীও লড়াই করে চলেছেন, বাংলার নাটককে, কীভাবে আরও সমৃদ্ধ আসনে দাঁড় করানো যায়। ঠিক তখনই এক বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি বিদায় নেন তাঁর বড় ভালোবাসা নাট্যাঙ্গন থেকে। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। এ যেন নক্ষত্র পতন! তার এই আসা যাওয়ার ইতিহাস বড়ই বেদনার। সেই বেদনার কথাই উঠে এসেছে ঢাকা থিয়েটারের ‘বিনোদিনী’র মধ্যে।
সেই বিনোদিনী দাসী, যে কিনা নাট্যসম্রাজ্ঞী, তৎকালীন সময়ে তিনি যে কাজটি পারেননি, তাঁর অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফ পেরেছেন।
মঞ্চে যতবার ‘বিনোদিনী’ নাটকটি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন শিমূল ইউসুফ প্রতিবারই তিনি জয় লাভ করেছেন। জয় করেছেন দর্শকদের হৃদয়। কারণ দর্শক হারিয়ে যাওয়া বিনোদিনীকেই দেখেছেন শিমূল ইউসুফের মধ্যে।
১৮৭৪ সালে বিনোদিনী ১২ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে ওঠেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ‘শত্রুসংহার’ নাটকের মাধ্যমে। নাটকটিতে তিনি ধ্রুপদীর সখীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটারে তৎকালীন যাবতীয় শ্রেষ্ঠ নাটকের প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করে যশ লাভ করেন তিনি।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। তার অভিনয় জীবনে মোট ৮০টি নাটকে ৯০টিরও অধিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আধুনিক বাংলা নাট্যমঞ্চের প্রথম সেই নারী অভিনেত্রী শ্রীমতি বিনোদিনী দাসীর লেখা আত্মজীবনীর আলোকে ‘বিনোদিনী’ নাটকের নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে।
নাটক ‘বিনোদিনী’ একটি ইতিহাসের স্বাক্ষী। সেই ইতিহাস প্রজন্মের কাছে ধরে রেখেছেন আমাদের মঞ্চকুসুম। যিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন। এখন পর্যন্ত তিনি ঢাকা থিয়েটারের ৩৪টির বেশি নাটকে অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, কোরিওগ্রাফার এবং পোশাক পরিকল্পনা, সহযোগী নির্দেশক ও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করেছেন। ১৯৮১ সালে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনকে সংগঠিত করতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। শৈশব থেকে শিমূল ইউসুফ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত এবং গণসঙ্গীতে ওস্তাদ হেলাল উদ্দিন, পিসি গোমেজ, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, ওস্তাদ ইমামউদ্দীন এবং সুধীন দাসের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নেন। তিনি আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন থেকে সঙ্গীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়েছেন।
রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চের শিল্পী শিমূল ইউসুফ ১৯৭৪ সালে ঢাকা থিয়েটারে যোগদানের পর থেকে পুরোপুরি মঞ্চে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পাশাপাশি শুদ্ধ সঙ্গীতচর্চা অব্যাহত রাখেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকের জীবনে শিমূল ইউসুফ দুই সহস্রাধিক নজরুল সঙ্গীত, গণসঙ্গীত- রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চে পরিবেশন করেন এবং মঞ্চের ষোল শতাধিক মঞ্চায়নে সফল অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- মুনতাসীর, কসাই, চর কাঁকড়া, শকুন্তলা, ফণীমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকা, একাত্তরের পালা, যৈবতীকন্যার মন, মার্চেন্ট অব ভেনিস, বনপাংশুল, প্রাচ্য, বিনোদিনী, ধাবমান, নষ্টনীড়, দ্য টেম্পেস্ট সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তাঁর একক অভিনয়ের নাটক ‘বিনোদিনী’ বিশ্বনাট্য অলিম্পিকস ও আন্তর্জাতিক মনোড্রামা উৎসবে মঞ্চস্থ হয় এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। নাটকের প্রতি প্রেম এবং জীবনকে নাটকের জন্য উৎস্বর্গ করে দেওয়া বিনোদিনীর পরে মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তা না হলে জীবনের এই প্রান্তে এসে যখন সবকিছু থেকে বিরোতি নেওয়ার কথা, তখনও মঞ্চে আলোছড়াতে প্রস্তুত আমাদের মঞ্চকুসুম।
এসএ/ এআর