ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

সিনেমা রিভিউ

গল্পের গভীরতা নেই ‘ডুব’ এ

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ০৬:১৭ পিএম, ১ নভেম্বর ২০১৭ বুধবার

অনেক দিনের ইচ্ছা ‘ডুব’র মধ্যে ডুব দিয়ে দেখবো গভীরতা কতটা! কারণ ‘ডুব’ চলচ্চিত্র নিয়ে কম তোড়জোড় তো হয়নি। মুক্তির আগেই দেশে-বিদেশে তুমুল হৈ-চৈ। তবে এই বিতর্ক কোনো অভিনেতার অভিনয়কে কেন্দ্র করে নয়, কোনো অশ্লীল দৃশ্য নিয়ে নয়, কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাহিনীর নির্মাণ নিয়ে নয়, এমনকি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার অতিরঞ্জন নিয়েও নয়।

দেশের একজন বিখ্যাত লেখকের জীবন ও কর্মের ছায়া গল্প নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ঘিরে নানা বিতর্ক। সিনেমাটি নিয়ে দুটি পক্ষের মুখমুখি অবস্থান। একপক্ষ বলছে এটি লেখক হুমায়ুন আহমেদের জীবনী নিয়ে তৈরি। অন্য পক্ষ বলছে এটি কোনো বায়োপিক নয়। নির্মাতা বলছেন- সিনেমাটি আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এমন গল্পের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ গল্পটি অন্য কারও জীবনের গল্পের সঙ্গে মিলে যেতেই পারে। তবে এটি কোনো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বায়োপিক নয়।

যা হোক, মুক্তির আগে এই জল্পনা কল্পনা শুনে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব ছিলো না। যাদের মনে হয়েছে সিনেমার গল্প তাদের পারিবারিক ঘটনার অবলম্বনে নির্মিত, তারা সেন্সর বোর্ডের কাছে অভিযোগ করেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে আটকে গেছে ‘ডুব’। এরপর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কিছু দৃশ্য কর্তন করা হয়। যদি কারও বায়োপিক না হয়, তবে কেনো এই কর্তন? প্রশ্নটা অবান্তর নয় নিশ্চয়ই। সেই প্রশ্নের উত্তর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডুব’র মধ্যেই আছে।

এতো গেলো মুক্তির আগের কথা। এবার আসা যাক; মুক্তির পরে কি প্রতিক্রিয়া এসেছে দর্শক ও চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছ থেকে।

২৭ অক্টোবর, শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে বহুল আলোচিত সিনেমা ‘ডুব’। শুরুতে অল্প কয়েকটি সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয় ‘ডুব’। উল্লেখ্য, সম্প্রতি টানা তিন সপ্তাহ হল দখল করে ছিলো ‘ঢাকা অ্যাটাক’। অনেক দিন পরে দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে লাইন দিয়ে দেশী সিনেমা দেখেছে। প্রথম দিকে কেউ কেউ টিকিট না পেয়ে ফিরে গেছেন। শুভ-মাহির অ্যাকশনধর্মী ছবি দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে। তবে দর্শক ভালোভাবে ওই সিনেমাটি গ্রহণ করলেও কিছু সমস্যা থেকেই গেছে। বাংলাদেশের নির্মাতারা এখনও সেই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন না। সে বিতর্ক এখন থাক। আশার কথা হচ্ছে- বেশি লগ্নি করলে তা ফেরত ওঠানো সম্ভব, যদি ভালো নির্মাণ হয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে ‘ঢাকা অ্যাটাক’র সিনেমা হল জয় করার পর ‘ডুব’ কি সাড়া জাগাতে পারবে? গত সপ্তাহে টাটকা বিনোদন নিয়ে ফিরে যাওয়া দর্শক ‘ডুব’র টানে আবারও কি হলমুখী হবেন?

ডুব দেখতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে. দর্শকরা হলমুখী হয়েছেন। বাংলা সিনেমার দর্শক আগের মতই আছে। ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শকের কমতি হয় না। দর্শক প্রতি সপ্তাহেই সিনেমা হলে যেতে ইচ্ছুক। ‘ডুব’ তারই প্রমাণ। ডুবের নেশায় দর্শক হলে ভিড় করেছে। নির্মাতা-প্রযোজক প্রচারণারও কমতি রাখেননি।

এবার গল্পে ফিরে যাওয়া যাক। যে বিতর্ক নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে নির্মাতার দ্বন্দ্ব চলছিলো তার অবসান ঘটেছে। দর্শক সিনেমা দেখে বলেছে এটি হতে পারে লেখক হুমায়ুন আহমেদের জীবনী অবলম্বনে। আবার হতে পারে সমাজেরই গল্প। তবে এটি যে, লেখক হুমায়ুন আহমেদের বায়োপিক নয় এটা পরিষ্কার। আবার এটাও পরিষ্কার যে, নির্মাতা গল্প লেখার সময় লেখক হুমায়ুন আহমেদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। গল্পের উপর সেই প্রভাব দেখেছে দর্শক।

তবে এটাও বস্তব যে, আমরা যদি হুমায়ুন আহমেদকে না চিনতাম, তার জীবনের গল্প না জানতাম, ‘ডুব’ মুক্তির আগে কোনো ধরনের ঝামেলা না হতো, তবে হয়তো কোনোভাবেই বলা হতো না যে, এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যাক্তির জীবনী অবলম্বনে নির্মিত।

আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, সেন্সর বোর্ড এই সিনেমার ২ মিনিট ২৫ সেকেন্ড কর্তন করেছেন। যদিও কেউ কেউ বলাবলি করছেন, কর্তনের পরিমাণ আরও একটু বেশি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তাতে করে গল্পের উপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছে। নির্মাতার গল্পের যে অংশ কর্তন করা হয়েছে হয়তো তাতে লেখক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে ওই অংশের কিছু মিল থাকলেও থাকতে পারে। সে আশঙ্কা করাই যায়।

পুরো সিনেমা দেখে মনে হয়েছে যে, নির্মাতা তার চোখ দিয়ে দর্শকদের কিছু বিষয় বুঝাতে চেয়েছেন। প্রথমত, স্ত্রী ও বড় বড় সন্তান রেখে অন্য নারীর সঙ্গে পিতার প্রেম। তাও মেয়ের ‘বান্ধবীর’সঙ্গে প্রেম। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে। সেই বিয়ে নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে পিতার দূরত্ব। এগুলো নিয়েই গল্পের উত্থান পতন।

সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা করতে হলে আগে আসি, ইরফান খান (সিনেমায় জাভেদ হাসান) প্রসঙ্গ নিয়ে। তিনি যে বাংলাদেশের বাঙালী নন তা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তার মেপে মেপে সংলাপ দেওয়া আর উচ্চরণ শুনে মনে হয়েছে তিনি অভিনেতা। বাস্তব চরিত্রের মানুষ নন। বিষয়টি দর্শকের কানে বেজেছে।

নির্মাতা বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যে, এটা হুমায়ুন আহমেদের জীবনের গল্প নয়, তা ফুটে উঠেছে জাভেদের দ্বিতীয় স্ত্রী নীতুর (পার্ণো মিত্র) চরিত্রটিতে। সিনেমায় নীতুর চরিত্র কোনোভাবেই হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। হুমায়ুন- শাওনের দাম্পত্য জীবন ‍ছিলো সুখের। তেমনটাই দেখেছি আমরা। কিন্তু ‘ডুব’ সিনেমায় ৫২ বছর বয়সী জাভেদ কোনোভাবেই চাচ্ছেন না মেয়ের ‘বান্ধবী’ নীতুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে। অথচ নীতুর চরিত্র নানাভাবে তাকে গ্রাস করছে।

রাতের আঁধারে জাভেদ হাসানের নয়নতারা ফিল্ম সিটির দেয়াল টপকে নীতু প্রবেশ করছে, নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে জাভেদ হাসানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। ‘দায়িত্বশীল পুরুষ’জাভেদ তাকে ধমকে ‘কী চাও তুমি’- প্রশ্ন তুলে ঘর থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে বিয়ে ও সংসার। দর্শককে বোঝানো হয়েছে দ্বিতীয় স্ত্রী জাভেদকে গ্রাস করে বিয়ে করেছে।

বোঝাই গেছে দ্বিতীয় স্ত্রী পার্ণো জাভেদের প্রিয় মানুষ নন। সিনেমায় বিয়ে, দ্বিতীয় সংসারের কোনো সুখস্মৃতি না দেখানোর কারণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। একমাত্র নির্মাতাই জানেন তিনি কি আসলেই হুমায়ুন আহমেদের জীবন থেকে গল্প নিয়েছেন কি না! সেখানে থেকে গল্প নিলে বলবো নির্মাতা কোনভাবেই হুমায়ুনের দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি। তাই বাস্তবের শাওনকে এ সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বিতর্ক এখানেই শেষ করি।

সিনেমার মূল গল্প নিয়ে বলা যাক। প্রথম দৃশ্য দেখানো হয় একটি কলেজ/স্কুল রিইউনিয়ন। সেখানে দু`জন বান্ধবী সাবেরী (তিশা) ও নীতুর (পর্ণো) দেখা হওয়া এবং সেখান থেকে ফ্লাশ ব্যাক। ২০১৭ থেকে এক লাফে ২০১০। পারিবারিক ভ্রমনে বের হয়েছেন চলচ্চিত্রকার জাভেদ হাসান। সেখানে তার স্ত্রীর সঙ্গে তার ঘুরতে যাওয়া এবং ফ্লাশব্যাকের ভেতরে আবার ফ্লাশব্যাক, সাল ১৯৯০।

জাভেদ হাসান আর নুরুন্নাহার মায়ার বিয়েটা হয় বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে। মায়ার কর্নেল বাপ সেটা মেনে না নিয়ে পুলিশ ডাকেন এবং সেখান থেকে গল্প এগোয়। বেশ হাস্যরসাত্মকভাবে সেই গল্প শেষও হয়।

গল্পের শুরুর দুই একটা দৃশ্যেই দর্শকরা বুঝে ফেলে জাভেদ মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভুগছেন। মূলত গোটা সিনেমাতেই জাভেদকে কিছুটা সংসার বিরাগী দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই সংসার বৈরাগ্যের মাঝেই জাভেদের জীবনের নতুন মোড় মেয়ের বান্ধবী নিতুকে জড়িয়ে পত্রিকার প্রতিবেদন। সেখান থেকে জন্ম নেয় পারিবারিক সংকট। সংসার থেকে আলাদা থাকা। নিতুর সঙ্গে নৈকট্য এবং নিতুকে বিয়ে। তার থেকে সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব।

সাবেরী এবং আহির (জাভেদ হাসানের ছেলে) সব সময় মায়াকেই সাপোর্ট দিয়েছে। যদিও সাবেরীর আক্ষেপ ছিল তার মায়ের প্রতি। কারণ তার মা অলস, সংসারের নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেনি। কিন্তু তার ভালোবাসা সব সময়ই মায়ের প্রতি ছিল অটুট। অপরদিকে বাবার প্রতি তার ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। তার উপর নিজেরই বান্ধবী।

বিরতির পর পুরোটা সময়েই জাভেদের প্রথম সংসারের সঙ্গে নিতু এবং জাভেদের দ্বন্দ্ব নিয়ে। একপর্যায়ে জাভেদ আত্মসমর্পন করে নিতুর কাছে। এরপর সিনেমা শেষ হয় জাভেদের মৃত্যু এবং তার দাফনের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করেও দুই পরিবারে সংকট তৈরি হয়।

জাভেদ হাসান চরিত্রে ইরফান খানের কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম। কিন্তু মার খেয়ে গেছেন দুর্বল চিত্রনাট্যের কাছে।

মায়া চরিত্রে রোকেয়া প্রাচীকে আরেকটু স্পেস দেওয়া দরকার ছিল। স্ত্রী হিসেবে ওনার ভূমিকাটা আরেকটু সামনে আনা প্রয়োজন ছিল।

নিতু চরিত্রে পার্নো মিত্র মূলত একটি নেগেটিভ চরিত্র, যে একটা সুখী সংসার ভেঙ্গে খান খান করে ভালো মানুষ জাভেদকে এবং সম্পত্তি প্রতিপত্তিকে গ্রাস করে নেয়। এমনকি তাকে প্রতিশোধ পরায়ন, হিংসুটে নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি নির্মাতার গল্পের জন্য পারফেক্ট।

সাবেরী, আপাত দৃষ্টিতে সিনেমার পার্শ্ব চরিত্র হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি সিনেমার মূল চরিত্র। চলচ্চিত্রকার মূলত সাবেরীর চোখেই সিনেমাটা দেখাতে চেয়েছেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সিনেমার প্রথম ও শেষ দৃশ্য দেখে।

ছবির শুরুর দিকের একটি দৃশ্যে জাভেদ তার মেয়েকে (তিশা) বলেন যে, ‘আমার বাবার মৃত্যু আমাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে। তা হল মানুষ মারা যায় তখনই যখন প্রিয়জনের সঙ্গে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়। আর ছবির শেষে জাভেদের মৃত্যুর পর আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এই একই কারণে তারও মৃত্যু ঘটেছে।

সব মিলিয়ে খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখেছে দর্শক। সাধারণ দর্শকদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা। তারপরও দর্শক কিছুটা খুঁজে নিতে সক্ষম হয়েছে মূল গল্প।

এবার ফারুকীর নির্মাণশৈলী নিয়ে কিছু আলোচনা আসা দরকার। আসলে বিষয়টা এমন যে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান। তাঁর কাছে দর্শক অনেক ভালো কিছু আশা করে। তার টেলিভিশনের নাটক নির্মাণের কৌশলে ছিলো একটি আলাদা ধরণ। বড় পর্দায় দর্শক সেই ধরনটি দেখতে চায় না। সিনেমার নির্মাণ কৌশলে ভিন্নতা চায়। কারণ একজন নির্মাতা যখন ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় আসেন তখন তাকে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয়। তা না হলে তার নির্মাণের মধ্যে ছোট পর্দার প্রভাব থেকেই যায়।

সেই প্রভাব থেকে এখনও মুক্তি মেলেনি নির্মাতা ফারুকীর। সত্যি কথা বলতে ‘ডুব’ ছবিতে কোনো কমপ্লেক্স চরিত্র নেই, সব সাদা কালো, সব সিম্পল। তবে ক্যামেরার কাজ প্রশংসা করার মতো।

তাহলে কেমন লেগেছে দর্শকদের ! নির্মাতা-প্রযোজকদের পক্ষ থেকে যে জরিপ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে দর্শকদের বলতে শোনা গেছে ‘ভালো’ শব্দটি। কিন্তু কিছু গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে ‘দর্শক হতাশা’র কথা। সমালোচকদের কাছে হতাশাটাই একটু বেশি।

এসএ / এআর