স্মৃতির মণিকোঠায় বাবু ভাই
রেজাউল হক চৌধুরী মুস্তাক
প্রকাশিত : ০৮:৪৫ পিএম, ৪ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০৬:৪২ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়ীকভাবে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাথে আমার আত্মীয়তার বন্ধন যেমন ছিল তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কটাও ছিল সমান্তরালভাবে।
জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। শুধুই কী রাজনীতি? ব্যবসা বাণিজ্য, সমাজসেবা, বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ সবখানেই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র গৌরবগাঁথা স্মৃতি চিরভাস্বর হয়ে আছে। তাঁর এতো পরিচিতি, যশ-খ্যাতির মাঝেও চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের কাছে তিনি ‘দানবীর বাবু মিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত।
বাবু ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আত্মীয়তার। সম্পর্কে তিনি আমার মামাতো ভাই। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় আট বছরের বড়। আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘চৌধুরী বাড়ী’ হলো আমার নানার বাড়ি। আমার নানা মরহুম আবদুল হাকিম চৌধুরী আর বাবু ভাইয়ের দাদা (পিতামহ) মরহুম আবদুল করিম চৌধুরী দুইজনে ছিলেন আপন ভাই। আমার নানারা জমিদার ছিলেন। বার্মায় (মিয়ানমার) আকিয়াবে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল। বাবু ভাইয়ের বাবা উকিল নুরুজ্জামান চৌধুরী আমার মামা।
আমাদের দু‘জনের ছোটকালের অম্ল-মধুর কত স্মৃতি আমার মানসপটে জমা হয়ে আছে তা আমাকে আজও নস্টালজিক করে তোলে। বাবু ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে কথাগুলো আজ আমার বার বার মনে পড়ছে। নানার বাড়িতে বেড়াতে গেলে মামা আবদুস সোবহান চৌধুরী, নাদেরুজ্জামান চৌধুরী এবং মামাতো ভাই আখতারুজ্জামান চৌধুরীর আপত্যস্নেহ এখনো আমার স্মৃতির মণিকোটায় জ্বল জ্বল করে। মনে পড়ে সেদিনের কথা, নানার বাড়ির সামনে পুকুরের ঘাটে পুকুরের জলে পা ভিজিয়ে রেখে সিড়িতে বসে থাকার কথা।
পুকুরে সবাই সাতার কাটছে , আমি বসে বসে তা দেখছি। কারণ আমি সাঁতার জানি না। এমন সময় বাবু ভাই আসলেন গোসল করতে। বসে থাকতে দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার শিখবে? মাথা নেড়ে আমি সায় দিলাম। তিনি বললেন ‘চল আজ তোমাকে সাঁতার শেখাব’। সেদিনই পুকুরে নেমে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার শেখার তালিম দিলেন বাবু ভাই। আমার সাঁতার শেখার প্রথম তালিমের স্মৃতিটুকু আমার মনের মাঝে এখনও গেঁথে আছে । অত্যন্ত মমতামাখা স্মৃতি দিয়ে বাবু ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কের ভীতটা রচিত হয়েছিল, যা মৃ্ত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল। এখনো বাবু ভাইয়ের কথা মনে হলে আমি স্মতিকাতর হই, চোখের কোণা ভিজে ওঠে। আজ বাবু ভাইয়ের না ফেরার দেশে চলে যাবার ৫ম বছর। অগণিত মানুষের দোয়া নিয়ে এই মানুষটি বেঁচে আছেন সকলের অন্তরে।
ঢাকার বুকে একখণ্ড চট্টগ্রাম খ্যাত ঐতিহ্যবাহী ‘চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’ জীবন সদস্য ছিলেন বাবু ভাই। তিনি ‘চট্টগ্রাম ভবন’ এর অন্যতম দাতা সদস্য । ৩২ তোপখানা রোডে আমরা যখন বহুতল বিশিষ্ট চট্টগ্রাম ভবন নির্মাণের ফান্ড গঠনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে গিয়েছিলাম বাবু ভাই তখন আমাদেরকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অনুদান দিয়েছিলেন। তারও আগে তোপখানা রোড়ের জায়গা ক্রয়ের জন্যও তিনি ১৯৭৫ সালে অনুদান দিয়েছেন। ১৯৯০-৯১, ১৯৯৬-৯৭ এবং ১৯৯৮-৯৯ সালে আমি চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এসময় সমিতির বিভিন্ন সংকটে, উন্নয়নে বাবু ভাই সবসময় আমাকে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম সমিতির নির্বাচনে সাবেক উপ-প্রধান মন্ত্রী জামাল উদ্দিন সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। কিছু অতি উৎসাহী লোক বাবু ভাইকে না জানিয়ে আমাদের প্যানেলের বিপরীতে সভাপতি পদে তাকে প্রার্থী করেছিলেন। বিষয়টি আমি জানার পর সাথে সাথে বাবু ভাইকে অবগত করি। আমার কথা শুনে বাবু ভাই বললেন, ‘তুমি জেনারেল সেক্রেটারী হচ্ছো’, আমাকে তো কেউ বলেনি- কাগজ দাও আমি নমিনেশন উইথড্রো করলাম।’ আমার প্রতি বাবু ভাইয়ের অগাধ বিশ্বাস দেখে সেদিন আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।
আমার মাকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। জীবদ্দশায় আমার মাকে দেখতে তিনি বেশ কয়েকবার আমার বাসায় গিয়েছেন। আমার মা বাবু ভাইকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। ষাটের দশকে আমি যখন ছাত্র রাজনীতিতে ক্রমশঃ সক্রিয় হতে থাকলাম। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্ব দিতে থাকলাম, তখন আমার মা প্রায় সময় আমাকে বলতেন আমি যেন সবসময় বাবু ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখে চলি। জানি না তৎকালীন উত্থাল রাজনৈতিক পরিবেশে আমাকে নিয়ে আমার মা উদ্বিগ্ন ছিলেন কিনা, কিন্তু তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন আমি যাতে বাবু ভাইয়ের সাথে সুসম্পর্ক রাখি।
আমার মায়ের সে নির্দেশ আমি পালন করে গেছি, বাবু ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, সম্মান আর আমার প্রতি বাবু ভাইয়ের স্নেহ আমৃ্ত্যু অটুট ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যাই। এরপরও জিয়া সরকার এবং পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী আমাকে রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানান প্রলোভন দেখায়। কিন্তু আমি কখনো গোয়েন্দাদের ফাঁদে পা ফেলিনি। বাবু ভাই একথা জানতেন। আমার সিদ্ধান্তে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। আমার সাথে তিনি অনেক বিষয় শেয়ার করতেন। রাজনীতির পাশাপাশি পারিবারিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক বিষয়ও আলোচনায় বাদ যেত না।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাবু ভাইয়ের সাথে আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। ৭০ এর নির্বাচনে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে নেতা ও কর্মীদের করণীয় শীর্ষক দিক নির্দেশনামূলক লিফলেট ‘নির্বাচন ও ছাত্রসমাজ’ নামে সারাদেশব্যাপী বিতরণ করা হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রচার ও সাংগঠনিক কার্যক্রমকে জোরালো করার জন্য টিম গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে আমাকে এবং জাহিদ সরওয়ার নিজামকে (বিসিসিআই ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও পরবর্তীকালে আফ্রিকার জাম্বিয়াতে দুটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার একটি হলো ‘ফাইন্যান্স ব্যাংক জাম্বিয়া লিমিটেড যেটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন তিনি নিজেই এবং অপর ব্যাংকের নাম ছিল ‘ক্রেডিট আফ্রিকা ব্যাংক লিমিটেড’ যার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন) দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
পাকিস্তান জাতীয় সংসদের আনোয়ার, বাশঁখালী, কুতুবদিয়া নির্বাচনী আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতাউর রহমান কায়সার এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালানোর জন্য। কেন্দ্রের নির্দেশনা মতো নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি আমরা কিছুটা কৌশলও অবলম্বন করেছিলাম। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফাকে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা যেমন অব্যাহত থাকবে অন্যতায় আমাদেরকে একদফা অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে যেতে হবে। এই বক্তব্যই ছিল ৭০ এর নির্বাচনের প্রচারের অন্যতম কৌশল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেমন একসূত্রে গাঁথা, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথে বাবু ভাইয়ের পরিবার অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তারও আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাবু ভাইয়ের পাথরঘাটাস্থ বাসা জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবু ভাই লন্ডন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
বাবু ভাইয়ের বড় ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি আমেরিকায় হার্ট অপারেশনের সময় মারা যান। ছোটভাই বশরুজ্জামান চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রাম শহরের চেরাগী পাহাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধেরও পর বাবু ভাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশ গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনককে হত্যার পর অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার মতো বাবু ভাইকেও অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু আর গোয়েন্দাদের প্রলোভনকে উপেক্ষা করে বাবু ভাই সেদিন তাঁর নীতিতে অটল ছিলেন। বাবু ভাই যদি ঐসময় এতটুকু নীতিভ্রষ্ট হতেন তাহলে তিনি অনেক আগেই মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ‘‘বাবু মিয়া’’ সে পথে হাঁটেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি তাঁর মতো এত মমত্ববোধ, ভালোবাসা খুব কম সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতার ছিল বলে আমি মনে করি। শুধুই কি তাই, পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী ছিলেন বাবু ভাই। তাই আজ বাবু ভাইকে বাদ দিয়ে যদি আওয়ামী লীগের ইতিহাস রচিত হয় , সেই ইতিহাস অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
বাবু ভাই অত্যন্ত দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কেউ কোনোদিন খালি হাতে ফিরে আসেনি। যাকে যেভাবে পেরেছেন সাহায্য করেছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য মানুষের। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্প কারখানা ছাড়াও ব্যাংক-বীমায়ও অসংখ্য বেকার যুবককে তিনি চাকরি দিয়েছেন। চাকরি দিতে গিয়ে তিনি কখনো কে কোন দলের বা মতাদর্শের তা দেখেননি, সব দল ও মতের মানুষকে তিনি চাকরি দিয়েছেন। এখানেই তাঁর উদার মানসিকতার পরিচয় আমরা দেখতে পাই। বাবু ভাইয়ের আরেকটি বড় গুণ হলো তিনি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করতেন। একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের পকেট থেকে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন। বড়ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরীর নামে নিজগ্রাম হাইলধরে এবং ছোটভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বশরুজ্জামান চৌধুরীর নামে বরুমছড়ায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি আনোয়ারা কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধূরী বাবু আজ আমাদের মাঝে নেই। বড়ো অসময়ে তিনি চলে গেছেন তিনি।
লেখক ব্যবসায়ী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।