ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কুচিয়ার বিদেশ যাত্রা

ইয়াসির আরাফাত রিপন

প্রকাশিত : ০৯:৫৪ পিএম, ৪ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১২:৩০ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

দেশে অনেকে কুচিয়া মাছ না চিনলেও বিদেশে ক্রমেই বাড়ছে এর চাহিদা। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে কুচিয়ার চাষ। এর মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কুচিয়া চাষ শুরু হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায়। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে চীন, জাপান, হংকং, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রায় ১৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কুচিয়া রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কমছে দেশের বেকারত্বের হার।

বাংলায়  কুচিয়া, ইংরেজিতে Asian swamp eel একটি ইল-প্রজাতির মাছ। Sybranchidae পরিবারের অন্তর্গত এই মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Monopterus cuchia।

কুচিয়া দেখতে সাপের মতো হলেও এটি এক প্রকার মাছ। যা দেশে এলাকা ভেদে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি মাছ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, হাওর, খাল-বিল, পঁচা পুকুর, ধানক্ষেতে এবং বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে পাওয়া যায় সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং ঔষধি গুণাগুণ সম্পন্ন এ মাছ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও এর চাহিদা বর্তমানে বাড়ছে।

কুচিয়া ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। মাছটি প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত জলাশয়ে প্রজনন করে। কৃত্রিমভাবে এটার প্রজনন ঘটানো এখনও সম্ভব হয়নি। শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা রোগ, ডায়াবেটিস, বাতজ্বরসহ অনেক রোগ সারাতে অনেকে কুচিয়া খেয়ে থাকেন।

যেভাবে শিকার করা হয় : উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁশের তৈরি চাঁই (এক ধরনের ফাঁদ) দিয়ে কুচিয়া শিকার করা হয়। এছাড়াও জাল, বড়শি ও বাঁশের তৈরি এক ধরনের হাতিয়ার দিয়েও কুচিয়া ধরা হয়।

চাষ পদ্ধতি : সাধারণত কৃত্রিম উপায়ে কুচিয়ার প্রজনন ঘটানোর এখনও কোনো মাধ্যম পাননি চাষিরা। স্থানীয় জলাশয় বা ঘের থেকে চাষিরা ছোট ছোট কুচিয়া ধরেন। পরে পুকুরের মধ্যে খাঁচা বসিয়ে চাষ করেন। অনেকে আবার পুকুর বা ঘেরের মধ্যে জাল দিয়ে খাঁচা তৈরি করে তার মধ্যে ছোট ছোট কুচিয়া দিয়ে বড় করা হয়। আবার অনেকে বাড়ির মধ্যেই ছোট ছোট জলাশয় তৈরি করে এটি চাষ করেন। এ ক্ষেত্রে কুচিয়াকে দিতে হবে নিয়মিত খাবার। সাধারণত শামুক বা ছোট মাছ কুচিয়ার প্রিয়। ২০০ গ্রাম একটি কুচিয়াকে নিয়মিত খাবার খেতে দিলে তিন মাসেই এর ওজন হতে পারে আড়াই থেকে তিন কেজি।

ওজন : বাংলাদেশের একটি কুচিয়ার ওজন সাধারণত ৩০০ থেকে ২০০০ গ্রাম বা দুই কেজি পর্যন্ত হয়। পৃথিবীর অন্য দেশে কুচিয়ার আকার ১০০০ গ্রাম বা এক কেজির বেশি হয় না।

দাম : এগুলো জীবিত বিক্রি করা হয়। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কুচিয়া শিকারী প্রীতম মণ্ডল জানান, আমরা স্থানীয় বাজারে এ মাছ বিক্রি করে আকার ভেদে প্রতি কেজির দাম পাই ২০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। একজন চাষি দিনে তিন থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত কুচিয়া ধরতে পারেন। যা থেকে দিনে ৭শ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারা যায়।

রফতানি আয় : বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৭ সালে প্রথম কাঁকড়া ও কুচিয়া রফতানি শুরু হয়। ওই সময় অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে এই দুই পণ্য রফতানি বাজার ছিল ২ হাজার ডলারের। বাংলাদেশে উৎপাদিত কুচিয়া সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কুঁচিয়া রফতানি করে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশ।

কুচিয়ার চাষ বিষয়ে উন্নয়ন প্রচেষ্টার সহকারি ভ্যালোচেইন ফ্যাসালেটর প্রোজেক্ট ম্যানেজার সোহরাব হোসেন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ায় এসব জমিতে ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেকে ঘেরে মাছ চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেক সময় ভাইরাসজনিত সমস্যায় মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময় বেকার হয়ে যায় পুরো এলাকার মানুষ। নেমে আসে অভাব।

তিনি বলেন, এ অবস্থা দূর করতেই পিকেএসএফ’র সহযোগিতায় আমরা চাষিদের মাছ চাষের পাশাপাশি কুচিয়া চাষের উপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তারাও ভালো ফল পাচ্ছে। এ অঞ্চলের কুচিয়া এখন বিশ্বের ১৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। স্থানীয় পাইকারি বাজারে বিক্রি করে এখন তাদের বাড়িতে সচ্ছলতা ফিরছে।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব আবুল বাসার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, আমাদের দেশ থেকে কুচিয়া জীবিত এবং প্রসেস পদ্ধতিতে রফতানি হয়। প্রথমে আমাদের দেশ থেকে প্রাকৃতিকভাবে যে কুচিয়া পাওয়া যেত সেগুলোই রফতানি হতো। এখন চাষিরা বিভিন্ন স্থান থেকে কুচিয়া ধরে খাঁচায় চাষ করছে। এগুলোর ওজন যেমন ভালো দামও ভাল।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। কুচিয়া রপ্তানিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখে মুক্ত জলাশয়ে আহরণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর/ডব্লিউএন