ঢাবি মাইম অ্যাকশন : অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নির্বাক প্রতিবাদ
মাহমুদুল হাসান
প্রকাশিত : ০৮:৩২ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার | আপডেট: ১২:০৭ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার
প্রাচীন ও শক্তিশালী শিল্পের মধ্যে মূকাভিনয় অন্যতম একটি শিল্প। এই শিল্পকে সারা বাংলাদেশে স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে ঢাবি মাইম অ্যাকশনের স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘না বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা’শ্লোগান নিয়ে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন’।
দেখতে দেখতে এ সংগঠনটি জাতীয় পরিসীমা পার হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তাদের প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুনাম কুড়িয়েছে এবং বিদেশে গিয়েও পুরস্কার বিজয়ী হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রোহিঙ্গা সমস্যা, পরিবেশগত বিপর্যয়, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যানজট সমস্যা, পথশিশুদের জীবন বাস্তবতা, নারীদের সামাজিক চিত্র, ছাত্র রাজনীতি, ধর্ম কেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলার বিপরীতে সাম্প্রতিক একাত্মতা, টেকনোলজির অপব্যবহার, মানবাধিকার এবং প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে এ সংগঠনটি।
ঢাবির এই সংগঠনটি ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউএনডিপি, এলায়েন্স (AllIANCE), ফ্রানচাইজ ডি ঢাকা, গ্যেটে ইন্সটিটিউট, ইএমকে সেন্টার, ওয়াটার এইড, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, গ্রে (GREY), এ টু আই (A to I), ড্রিম ডিভাইসার ছাড়াও সমাজ সচেতনতার লক্ষ্যে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছে।
ঢাবি মাইম অ্যাকশন প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি সমাজ সচেতনতামূলক মাইম শো প্রদর্শন করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- রোহিঙ্গাদের নিয়ে-‘নো ল্যান্ডস ম্যান’, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ‘ক্রস কানেকশন’, ধর্মীয় অস্থিতিশীলতার বিপরীতে সম্প্রীতির শিক্ষা ‘রিভার্স’, প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে ‘সেলফি ম্যানিয়া’, পথশিশুদের নিয়ে ‘জীবন: যেখানে যেমন’ আসামাজিক প্রেমের কাহিনী নিয়ে ‘ভালোবাসা এবং অতপর’, ২৫ মার্চ রাত নিয়ে ‘কালোরাত’, স্বাধীনতা ও মুক্তিযু্দ্ধ নিয়ে ‘৭১’, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে ‘আপনার অনুভূতি কি’, বিদেশি চ্যানেল ও সংস্কৃতির করাল গ্রাস ‘দখল’, রাজনীতিবীদদের টক শো নিয়ে ‘টকশো’, শারীরিকভাবে অক্ষমদের নিয়ে ‘My Dream: I can walk’, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘ অপারাজেয় বাংলা’এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে ‘ ফুটবল ফুটবল’।
বিশ্বের যে কোনো জায়গায় কোনো মানবিক সংকট তৈরি হলে এর প্রতিবাদে এবং মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে নির্বাক প্রতিবাদ করে এই সংগঠনটি ।
মূকাভিনয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরাই ঢাবি মাইম অ্যাকশনের অন্যতম কাজ। অর্থনীতি, শিক্ষা ও খেলাধুলায় বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গণে মূকাভিনয় নিয়ে বাংলাদেশের শক্তিশালী উপস্থিতি এরই প্রমান বহন করে। এরই মধ্যে এই সংগঠনটি ভারত ও আর্মেনিয়াতে পারফর্ম করেছে।
ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনির্ভাসিটি আয়োজিত বিশ্বমিল সাংস্কৃতিক উৎসব প্রতিযোগিতা-২০১৬ তে মূকাভিনয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাবি মাইম অ্যাকশন। এছাড়াও এ সংগঠনটি দেশে ও বিদেশে ৩৫০টির মত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিল।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মীর লোকমান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন ‘ক্রিকেট যেমন ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক তেমনি আগামী দিনে মূকাভিনয়ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে।’
তিনি বলেন, মূকাভিনয় একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম। মূকাভিনয় হচ্ছে বিশেষ ঘটনা বা কাহিনীকে উপজীব্য করে অভিনয় উপস্থাপনের প্রক্রিয়া। ইংরেজি প্রতিশব্দ Mime বা মূকাভিনয় অর্থ হচ্ছে মুখে শব্দ না করে শারীরিক বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা।
এ বছরের ১৭ ডিসেম্বর কোরিয়ার সিউলে মূকাভিনয়ে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে সংগঠনটির। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি ১১ ও ১২ তারিখে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগঠনটি।
সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে ১০০-এর মধ্যে থাকা দু’শ বছরের পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় University of Ghent এর সেমিনার প্রদর্শনী ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করবে সংগঠনটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার জেলা সাংস্কৃতিক কর্মীরা টিম গঠন করে মূকাভিনয় নিয়ে কাজ করছে।
তবে শুরুতে তাদের পথচলা খুব একটা সহজ ছিল না। শুরুতে রির্হাসালের জায়গা সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল। তাদের কাজ পরিচালনার জন্য অডিটরিয়াম পাওয়াও অনেক কষ্ট ছিল। মাইম বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন হওয়ায় এ বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম ছিল। তবে বর্তমানে মাইমের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্প ও শিল্পীর প্রতি মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হচ্ছে।
মূকাভিনয় শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখাসহ শৃজনশীল মানুষ গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুবকরা নিজেদেরকে এবং সমাজকে বিভিন্ন ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
এ শিল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাই এই শিল্পের মাধ্যমে একজন যুবক সহজেই নিজেকে মানবিকবোধ সম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গঠন করতে পারবেন।
ঢাবি মাইম অ্যাকশন এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় মূকাভিনয়ের টিম গঠন করা এবং কর্মশালা ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় এর প্রচলন করা। এছাড়াও স্কুল ও কলেজে প্রেজেনটেশন করার ব্যবস্থা করা এবং মূকাভিনয় সম্পর্কে ধারণা দেয়া, আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসবে যোগ দেয়া। সর্বপরী এই শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করানোই হচ্ছে এই সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য।
এম/ডব্লিউএন