মুগডালে নতুন স্বপ্ন দেখছেন ভোলার কৃষকরা
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ১০:৫৫ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ১১:০২ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ভোলা জেলায় ব্যাপকহারে শুরু হয়েছে মুগডালের চাষ। জেলার ৫টি উপজেলার কৃষকরা ক্রমেই ডাল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ডাল চাষের মাধ্যমেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন তারা। এখানকার উৎপাদিত মুগডাল এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। সোনামুগ, অস্ট্রেলিয়ানমুগ ও বারী জাতের মুগডালের চাষ হচ্ছে এখানে। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বারী জাতের মুগডাল।
জাপানি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ ইউগ্লেনার’ এ ডাল কিনে নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে উচ্চমূল্যে ডাল বিক্রি করতে পেরে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আগামীতে তারা দেড়শ’ টন মুগডাল জাপানে রপ্তানির আশা করছেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশের উৎপাদিত এ মুগডাল জাপানে সালাদ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। জাপানের সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার শশীভুষণ এলাকায় কৃষকদের কাছ থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ ইউগ্লেনার’ এ মুগডাল কিনছে। গ্রামীণ ইউগ্লেনার ম্যানেজার তমোইয়াসু এবানা মুগডাল সংগ্রহের এ কাজ শুরু করেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
এলাকার গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর মো. আবু বকর বলেন, ‘বিদেশি ওই প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রথমবারের মতো আমাদের ১০০ টন মুগডাল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু ফসল উত্তোলনের সময় আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় আমরা সে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি করতে পারি নাই। মাত্র সাড়ে চার টন মুগডাল আমরা রপ্তানি করতে পেরেছিলাম। তবে আগামীতে আমরা দেড়শ’ টন রপ্তানি করবো বলে আশা করছি।’
এলাকার কৃষকরা জানান, প্রশিক্ষণ কারিগরি সহায়তা ও অনুকূল পরিবেশ থাকায় তারা বেশি জমিতে মুগডালের চাষ শুরু করেছেন। এখন মাঠজুড়ে কেবল মুগডালের সমারোহ। পাল্লা দিয়ে মাঠে মাঠে মুগডালের চাষ। শুধু পুরুষরাই নন, এ কাজে বরং নারীদের সংখ্যাই বেশি। একরপ্রতি ফলন আসছে ১৪ থেকে ১৫ মণ। বাজারে প্রতিমণ ডাল বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। এভাবে বেশি দামে ডাল বিক্রি করতে পেরে তারা বেজায় খুশি।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানু্দ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরা— এ সাত উপজেলায় এবার ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে মুগডালের চাষ হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে উন্নত জাতের বাড়ি মুগ-৬ ছাড়াও নানা জাতের মুগ ডালের চাষ করেন কৃষকরা। এবার এ মুগডালের চাষ আরও বেড়েছে।
ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের চরপোটকা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন জানান, গত মৌসুমে তিনি চল্লিশ শতাংশ জমিতে মুগডাল আবাদ করেছিলেন, উৎপাদন খরচ হয়েছিল চার হাজার আটশত টাকা, ফলন পেয়েছিলেন পাঁচমণ ও বিক্রি হয়েছিল পনের হাজার ছয়শত টাকা।
একইভাবে পশ্চিম ইলিশার দক্ষিণ পরপাতা গ্রামের মো. শাজাহান পয়ত্রিশ শতাংশ জমিতে মুগডাল আবাদ করেছিলেন। আবাদে খরচ হয়েছিল তিন হাজার পাঁচশত টাকা, ফলন পেয়েছিলেন চার মণ দশ কেজি ও বিক্রি হয়েছিল দশ হাজার একশত চল্লিশ টাকা। প্রতি কেজি আটাত্তর টাকা দামে বিক্রি করেছিলেন।
ভেদুরিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম চরকালী গ্রামের কৃষক মো. ইয়াছিন ১’শ শতাংশ জমিতে মুগডাল আবাদ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল আট হাজার টাকা, ফলন পেয়েছিলেন ১০ মণ, যার বিক্রয় মূল্য পেয়েছেন একত্রিশ হাজার পাঁচশত নব্বই টাকা।
গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর মো. আবু বকর জানান, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ)’র অর্থায়নে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের পেইজ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা জেলায় মুগডাল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভোলা জেলার ৫টি উপজেলায় ৮ হাজার কৃষক মুগডাল উৎপাদন করেন। উৎপাদনকৃত মুগডাল বছরের শুরুতে এক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত ডাল পরে রপ্তানি করা হয়। সেখান থেকেই মুগডালের চাষ ও রপ্তানির পথ উম্মুক্ত হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের পেইজ প্রকল্পের আওতায় মুগডালের জাত উন্নয়ন ও বাজার জাতকরণের উপর গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা জেলার ৫টি উপজেলায় ৮ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ ও ডিলারের মাধ্যমে বীজ সরবরাহ করে আসছে।
গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার মুগডাল ও সুগন্ধি ধান উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ পেইজ প্রকল্পের স্থানীয় প্রতিনিধি মো. মোস্তফা কামাল জানান, জাপানি আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশের মুগডাল কিনে নিচ্ছে। বিক্রয় সহজতর হওয়ায় কৃষকরা মুগডাল চাষে আরও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। আর আমরা কৃষকদের আগ্রহ কাজে লাগিয়ে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছি।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, কৃষিবিদ প্রশান্তকুমার সাহা জানান, সরকারের পাশাপাশি বে-সরকারি সংস্থাগুলো মুগডাল চাষাবাদ বাড়াতে কাজ করছে। তারমধ্যে গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা এবার ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ডালগুলো উচ্চমূল্যে কিনে নেয়ায় কৃষকরা ডাল চাষে আরও আগ্রহী হয়ে উঠছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ।
গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর মো. আবু বকর আশা প্রকাশ করে বলেন, যেভাবে এ ডাল চাষে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন, তাতে আগামী ৩ বছরের মধ্যে ভোলার ২শ’ একর জমিতে এ ডাল চাষ হবে। যা সরাসরি জাপানে রপ্তানির মাধ্যমে এলাকার কৃষকদের জীবন-যাত্রা বদলে যাবে।
আরকে/ডব্লিউএন