ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

দেশেই সব রোগের উন্নত চিকিৎসা সম্ভব : ডা. আশীষ

প্রকাশিত : ০৪:৪১ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার

চিকিৎসকদের ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’ বলা হয়। ঈশ্বরের পরেই মানুষের জীবন-মরণের বিষয়টি ডাক্তার বা চিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করা এমনই একজন চিকিৎসক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতি সন্তান ডা. আশীষ চক্রবর্তী। তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চিকিৎসায় ইতিমধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। সম্প্রতি একুশে টিভি অনলাইনের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি ব্যক্তিগত জীবন, ক্যারিয়ার এবং দেশীয় স্বাস্থ্য খাতের নানা দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের সহ-সম্পাদক সোলায়মান হোসেন শাওন

ইটিভি অনলাইন : আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে ইউনিভার্সেল হাসপাতাল। শুরুর গল্পটি যদি বলতেন?
ডা. আশীষ : ১৯৯৬ সালে আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবঃ) এম.আবদুর রহমান। একদিন প্রীতিদি (প্রীতি চক্রবর্তী, হাসপাতালটির বর্তমান চেয়ারম্যান) বললেন, এটি বিক্রি হবে। আমি তখন উৎসাহী হয়ে খোঁজ-খবর নিলাম। অনেকের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, দক্ষ হাতে হাসপাতালটি পরিচালনা করতে পারলে এটি বিক্রি করার দরকার নেই। তখনই এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম এবং এর সাথে যুক্ত হলাম। পুরো হাসপাতালটিকে ঢেলে সাজালাম। ২০০৪ সাল থেকে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদের মাধ্যমে হাসপাতালটির কার্যক্রম দ্রæত গতিতে পুনরায় শুরু হয়।

ইটিভি অনলাইন : হাসপাতালটির বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
ডা. আশীষ : ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি সাধারণ মানুষের আস্থার মূল্য রাখতে পেরেছে। এখানে একই ছাদের নিচে সব ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে। নতুন ব্যবস্থাপনার তত্ত¡াবধানে আমরা আধুনিক চিকিৎসা সেবার সকল উপাদান রাখার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে “জিরো টু এডাল্ট” আইসিইউ স্থাপন এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল এমআরআই আমরাই প্রথম বাংলাদেশে চালু করি। একই জায়গা থেকে ডায়াগোনসিস থেকে ওপেন হার্ট সার্জারির মতো গুরুতর চিকিৎসা সেবাও দিয়ে যাচ্ছি।

ইটিভি অনলাইন : এ হাসপাতালে তো কার্ডিয়াক সেবা দেয়া হয়...

ডা. আশীষ : আমাদের রয়েছে একটি ‘ওয়ান স্টপ কার্ডিয়াক সেন্টার’। ২০১৫ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের ২য় সপ্তাহে আমরা এ সেবা কার্যক্রম শুরু করি। সেন্টারটিতে ৩৫টি শয্যা রয়েছে। এখানে এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, ওপেন হার্ট সার্জারী, ভালভ সার্জারী, পেস মেকার প্রতিস্থাপনসহ ২৪ ধরনের জরুরী এবং সাধারণ কার্ডিয়াক সেবা দেয়া হয়। সারা বছর খোলা থাকে এই সেন্টারটি। ফুল টাইম দক্ষ চিকিৎসক এবং নার্স নিয়োজিত রাখা হয়। ইতোমধ্যে আমরা সফলভাবে হৃদরোগের বেশকিছু প্রসিডিওর সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। সদ্য সমাপ্ত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সে একটি কার্ডিও এম্বুলেন্স সেবা প্রদানের মাধ্যমে কার্ডিওলজি সেবায় আমাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা ওই কনফারেন্সের কার্ডিয়াক পার্টনার ছিলাম। দেশ ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জরুরী সেবা দিতে কনফারেন্সের পুরোটা সময় আমাদের এ এম্বুলেন্স সম্পূর্ণ অপারেটিভ ছিল। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। চলতি আয়কর মেলায় “হেলথ কেয়ার পার্টনার” ছিল ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ।   

ইটিভি অনলাইন : এদেশে এত দক্ষ চিকিৎসক এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকার পরেও মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। কেন?


ডা. আশীষ : প্রথমত বলি, আগের যে কোনো সময়ের থেকে এখন বাংলাদেশেই সব ধরনের রোগের উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। এরপরও অনেকেই বিদেশে যান। অনেকে মন থেকেই বিশ্বাস যে, বিদেশের চিকিৎসা উন্নত। এদেরকে আপনি যত ভাল সেবাই দেন না কেন, তারপরও বিদেশে যাবেই। এ ব্যাপারটি আমাদের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভাল নয়। অল্প অল্প করে হিসেব করলেও প্রতি বছর দেশীয় মুদ্রার একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকে আবার চিকিৎসার উছিলায় শপিং করতেও যায়।

ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ রোগীদের আস্থা নেই? অনেক সময়ই আমরা ভুল চিকিৎসার অভিযোগের কথা শুনি। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?


ডা. আশীষ : আমাদের দেশের চিকিৎসকদের মাঝে মেধা এবং যোগ্যতার কোনো অভাব নেই। সীমিত সুযোগে ব্যাপক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। রোগীদের সমস্যার কথা মনযোগ দিয়ে শুনে এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করলে ভাল চিকিৎসা দেয়া সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। আর ‘ভুল চিকিৎসা’ প্রসঙ্গে বলব, চিকিৎসকরা ঐশ^রিক ক্ষমতা সম্পন্ন নন। কিন্তু রোগীর আত্মীয়-স্বজন আমাদেরকে মাঝে মাঝে তেমনটাই মনে করেন। কিছু কিছু সময়ে আমরা আমাদের শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করেও সফল হতে পারি না। এমন সময় অনেক রোগীর আত্মীয়ই না বুঝেও আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আমরা এমনও কেস দেখেছি, সদ্য মৃত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হলে আত্মীয়রা একে চিকিৎসকের ভুলে মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন।

ইটিভি অনলাইন : এবার আপনার ব্যক্তি জীবন নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। ডা. আশীষের আড়ালে কে লুকিয়ে আছেন?


ডা. আশীষ : ব্যক্তি আশীষ চক্রবর্তী আর খুব একটা বেশি নেই (হাসতে হাসতে)। এখন যিনি আছেন, তিনি ডা. আশীষ চক্রবর্তীই। তবুও বলব, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। সরাইল উপজেলায় আমার বাড়ি। অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাস করি। চিকিৎসা সেবা খাতে ব্যস্ততার পাশাপাশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাÐেও নিজেকে জড়িত রাখার চেষ্টা করি।

ইটিভি অনলাইন : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্রিস্টান হাসপাতাল উন্নয়নে আপনার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আপনার ক্যারিয়ারের শুরু এবং এত দূর পাড়ি দেবার পথটি কেমন ছিল?
ডা. আশীষ : কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে বের হয়ে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী খ্রিস্টান মেডিকেল সেন্টারে চীফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করি। স্থানীয়দের কাছে এটি মিশন হাসপাতাল নামেও পরিচিত। এ হাসপাতালে আমার কর্মজীবন আসলেই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। হাসপাতালটি এক রকম মৃতপ্রায় ছিল। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে এটিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি স্পন্দনশীল এবং আস্থাজনক হাসপাতালের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হই। এরপর ২০০৪ সালে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং জাপানে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। এখন সব চিন্তা-ভাবনা এই হাসপাতালকে ঘিরে।

ইটিভি অনলাইন : আবারও হাসপাতালের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাসপাতালটির কলেজ বা একাডেমিক কার্যক্রম কেমন চলছে?
 ডা. আশীষ : আমাদের হাসপাতালটির চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করেছে। কিছুদিন পর প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বের হবে। ২০১৩ সালে আমাদের এ কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১ম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবায় দক্ষ নার্স নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিভার্সেল নার্সিং ইন্সটিটিউট। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের ¯েøাগান হচ্ছে এম.বি.বি.এস + মানবতা = চিকিৎসক। চিকিৎসা খাতে এখনও যতটুকু পেশাদারিত্বের অভাব আছে, তা মোচন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, আমাদের কলেজই এখন একমাত্র মেডিকেল কলেজ যেখানে বন্ধুসভার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

ইটিভি অনলাইন : বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের জন্য ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ইতোমধ্যে অনেক সমাদৃত হয়েছে। এসব কার্যক্রমের বিস্তারিত জানতে চাচ্ছি।


ডা. আশীষ : আমাদের হাসপাতালটিকে আমরা নিছক “প্রাইভেট হাসপাতাল” নামক একটি ট্যাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পরিচালিত কার্যক্রম। সাধারণ উন্নত প্রযুক্তির সেবাসহ প্রান্তিক এবং গরীব-অসহায় রোগীদের জন্য আমাদের রয়েছে “টেলিমেডিসিন সার্ভিস”। বিগত ৪ বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে “আশুতোষ চক্রবর্তী শিক্ষাবৃত্তি” প্রদান করা হচ্ছে। আমাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক উদ্যোগ হচ্ছে “গরবিনী মা”। ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর ‘মা দিবসে’ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কীর্তিময় মায়েদের সম্মাননা জানাই।

ইটিভি অনলাইন : হাসপাতালটিকে ঘিরে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
ডা. আশীষ : আমাদের একটি স্লেগান আছে। তা হচ্ছে “হাসিমুখ চাই সবার”। এই স্লোগানকে বাস্তবায়ন করাই আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। আমরা প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাই। আর এ লক্ষ্য অর্জনেই অবিরাম কাজ কওে যাচ্ছি।

ইটিভি অনলাইন : বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা কোন পর্যায়ে রয়েছে?
ডা. আশীষ : বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার সুনাম দিন দিন বাড়ছে। শিশু মৃত্যু কমার হারে আমরা ভারত থেকেও এগিয়ে রয়েছি। ইউনিয়ন পর্যায়েও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ে উঠছে। গ্রাম পর্যায়ে এখন এমবিবিএস ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে। তাই এখন আর কেউ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে না। এভাবে সেবার মান বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে উন্নত চিকিৎসার জন্য কাউকে আর বিদেশে যেতে হবে না।

//ডিডি//এআর