ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে পিকেএসএফ’

প্রকাশিত : ০৫:৫৪ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০১৭ সোমবার

পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল করিম

পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল করিম

প্রান্তিক জনগোষ্ঠির দারিদ্র বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ অর্থায়নকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। ১৯৯০ সালে ২৩টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এখন দেশব্যাপী বিস্তৃত। দেশের মানুষকে দারিদ্র্যের জাতাকল থেকে বের করে আনতে বহুমাত্রিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবদান দিন দিন বেড়েই চলেছে।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ও এর সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তা ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রদর্শণে সম্প্রতি একটি মেলার আয়োজন করা হয়। ‘ছয় দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলা-২০১৭’ নামে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে।

সেই মেলা ও পিকেএসএফ’র কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল করিমের মুখোমুখি হয় একুশে টেলিভিশন। টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাতকারটি অনুলিখন করেছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম

একুশে টেলিভিশন: পিকেএসএফ আয়োজিত ‘ছয়দিন ব্যাপী উন্নয়ন মেলা-২০১৭’ সম্প্রতি শেষ হলো। মেলায় কেমন সাড়া পেলেন, মেলার উদ্দেশ্যটা আসলে কী ছিল?

আব্দুল করিম: ১৯৯০ সালে পিকেএসএফ যখন যাত্রা শুরু করে, তথন দুই হাজার ১২ জন সেবা গ্রহীতা ছিল। সে সময় ২৩টি সহযোগী সংস্থা ছিল। মূলত ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েই পিকেএসএফ যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে আমরা ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে উপযু্ক্ত ঋণ দিচ্ছি। একজন উদ্যোক্তাকে আমরা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিচ্ছি। সুতরাং এখন এটা ক্ষুদ্র ঋণেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রম বিস্তৃত।

আমরা এনজিওদের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করি। যাদেরকে আমরা সহযোগী সংস্থা বলি। সারা বাংলাদেশে আমাদের আট হাজার ৬০০ এর বেশি শাখা আছে। যেগুলো নিঝুম দ্বীপ থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

আমরা এক কোটি ২৭ লাখ ১৫ হাজার পরিবারকে সহায়তা করি। যার দেড়গুণ করলে প্রায় পাঁচ কোটি সেবা গ্রহিতাকে আমরা সেবা দিচ্ছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেবা গ্রহীতারা আমাদের টাকা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে। সেই পণ্যের প্রদর্শন ও প্রচারের জন্য আমরা এ মেলার আয়োজন করে থাকি।

উদ্দেশ্য ছিল আমাদের এ গরিব মানুষগুলোর উৎপাদিত পণ্য তারা যাতে ন্যয্য মূল্যে বিক্রি করতে পারে। এগুলো যাতে পরিচিতি লাভ করে। এগুলোর যাতে ব্র্যান্ডিং হয়।

আমরা বিষমুক্ত সবজি, বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদনে অর্থায়ন করি। এছাড়া কুচিয়ার চাষ, কাকড়ার চাষ এবং অন্যান্য নতুন ধরণের যেমন- কোয়েল, টার্কি, ফুল, মধু চাষেও আমরা অর্থায়ন করছি। এ ধরণের বিচিত্র সব পণ্যের প্রদর্শন ঘটাতে আমরা এ মেলার আয়োজন করে থাকি। এবারের মেলায় পর্যাপ্ত সাড়া পাওয়া গেছে।

মেলায় এবার ১৩৩টি স্টল ছিল। ৯০টি সংস্থা ছিল। যার মধ্যে সরকারি দপ্তর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, সোশ্যাল ডিভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি সরকারি দপ্তরও ছিল। সব মিলিয়ে পণ্য প্রদর্শন, প্রযুক্তি প্রদর্শন এবং কর্মকাণ্ড প্রদর্শন ঘটাতেই এ মেলার আয়োজন।

একুশে টেলিভিশন: মেলায় মানুষকে সচেতন করতে কী কোনো ধরণের সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল?

আব্দুল করিম: আমরা পাঁচ দিনের সেমিনারের আয়োজন করি। সেমিনারগুলো যুগোপযোগী উপযুক্ত বিষয়ের ওপরে হয়। সেমিনারে আমরা পাঁচ জন মন্ত্রী ও চার জন সচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর। যেমন- এসডিজি। এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর সেমিনারের আয়োজন হয়। যেখানে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করে। এখানে পিকেএসএফের অর্জনগুলোও তুলে ধরা হয়।

একুশে টেলিভিশন: আমরা জানি মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা আসলে ওইভাবে সফল হতে পারছেন না। তো এ ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে?

আব্দুল করিম: এখন শুধু ক্ষুদ্র ঋণ নয়, ঋণের পাশাপাশি আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, প্রযুক্তি দিচ্ছি, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিচ্ছি। সব মিলিয়ে আমরা একটা প্যাকেজ দিচ্ছি। আর্থিক ও আর্থিক বহির্ভূত সেবা দুই দিচ্ছি। উদ্দেশ্য হলো- ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করা।

আমরা বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা গুচ্ছ চিহ্নিত করেছি। যেমন- ভৈরবের পাদুকা শিল্প, যশোরের গদখালির ফুল, যশোর গ্রীষ্মকালীন  টমেটো, ঝাউদিয়ার গরু মোটাতাজা করণ, কুষ্টিয়ার ব্লাক বেঙ্গল ছাগল, সাতক্ষীরা কাকড়া মোটাতাজা করণ, কুচিয়ার চাষ, মৌলভী বাজার টার্কির চাষ, সুন্দরবন এলাকার মধু চাষ। এভাবে আমরা ব্যবসা গুচ্ছ তৈরি করেছি।এখানে অর্থায়ন করছি, প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যাতে তারা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।

একুশে টেলিভিশন: মেলার মাধ্যমে অনেক উদ্যোক্তা তাদের পণ্যের প্রদর্শন করেছেন। এটি আসলে নিয়মিত করা যায় কী না?

আব্দুল করিম: মার্কেটিং অনেকটা চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য। আমাদের বহু উৎপাদিত পণ্য অনেক বেশি মানসম্মত ও উন্নত। যেমন- আমাদের হস্তশিল্প সতরঞ্জি ও  টুপি ওমানে রপ্তানি হচ্ছে, কাসার জিনিস রপ্তানি হচ্ছে। এসব পণ্যের মার্কেটিংয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য পিকেএসএফ শ্যামলীতে বিশাল এক ভবন করবে। সেখানে তৃণমূল পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের প্রদর্শন হবে। সেখানে আইটির সহযোগিতায় ভার্সুয়াল মার্কেট তৈরি করা হবে। পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করা হবে। শুধুমাত্র তৃণমুল পর্যায়ের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য এ ভবনটি তৈরি হবে।

একুশে টেলিভিশন: মেলায় উদ্যোক্তাদের পণ্য ক্রয়ে ক্রেতাদের চাহিদা কেমন ছিল?

আব্দুল করিম: বিপুল চাহিদা ছিল। ভিয়েতনামের যে দোকানটি তাদের পণ্য নিয়ে আসছিল। দুই দিন পরে দেখা যায়- তাদের সে পণ্য শেষ হয়ে গেছে। চাহিদা মেটাতে তাদের আর একজন প্রতিনিধি পরে আরও পণ্য নিয়ে আসলেন। সে হিসেবে মেলায় ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্যাশ পাওয়া গেছে। ৫০ লাখ টাকার পণ্যের অর্ডার পাওয়া গেছে। মেলার শেষের দিনে অনেক পণ্য পাওয়া-ই যায় নাই। সে দিক থেকে মেলা সফল হয়েছে।

একুশে টেলিভিশন: এ মুহুর্তে পিকেএসএফ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আসলে কী করছে?

আব্দুল করিম: দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। দারিদ্র্য দূরিকরণে বহুমাত্রিক সমাধান দরকার। সে লক্ষ্যে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সমন্বিত উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি উদ্ভাবন করেছেন। এটা সমৃদ্ধি কর্মসূচি।এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রশিক্ষণসহ সমন্বিত ও অন্তর্ভূক্তিমূলক কার্যক্রম আছে। আগামী ২০২১ সালে দেশ মধ্যম আয়ের কাতারে এবং আগামী ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যাবে। সে লক্ষ্যে আমরা আমাদের কর্মসূচি সাজিয়েছি। যাতে করে পিকেএসএফ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

পিকেএসএফ সম্প্রতি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সাফল্য। ইতোমধ্যে আমরা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে কমিউনিটি ক্লাইমেট চেঞ্জ নামে একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছি। আমরা এশিয়ান ডিভলপমেন্ট ব্যাংকের আওতায় সারা দেশে ওয়েব হোস্টিং, ওয়েব ডিজাইনিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এছাড়া পানির কাজ, বৈদ্যুতিক কাজ, মোবাইল মেরামতের কাজসহ বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। শর্ত হলো এখানে যারা প্রশিক্ষণ দিবে তাদের ৭০ শতাংশকে প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কাজ দিতে হবে।

আমাদের অতি দারিদ্র্যের জন্য ব্রিটিশ সহায়তায় বৃহৎ একটি প্রকল্প আসছে। সেটা পিকেএসএফ বাস্তবায়ন করবে। আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ইফাদের সহায়তায় পেইজ নামক একটি প্রকল্প আছে। ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তায় আরও অনেক সহায়তা আসবে এশিয়ান ডিভলপমেন্ট ব্যাংক, বিশ্ব ব্যাংক এবং ইসলামী ডিভলপমেন্ট ব্যাংক থেকে।

আমরা ক্ষুদ্র ইনস্যুরেন্স নামে নতুন একটি সেবা চালু করেছি। যেটাকে আমরা সুরক্ষা সেবা বলছি। যেমন আমরা যখন গরু মোটাতাজা করণে এক লাখ টাকা ঋণ দেয়। তখন ১০০ বা ২০০ টাকা কেটে রাখি প্রিমিয়াম হিসেবে। যদি গুরুটি মারা যায় বা চুরি হয়ে যায়, মালিক আবার পুরো টাকাটা ফেরৎ পায়। এভাবে সুইচ ডিভলপমেন্ট কো-অপারেশনের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করছি। এর আগে আমরা জাপান ফান্ড ফর প্রভারটি রিডাকশন এর মাধ্যমে এ ইনস্যুরেন্স প্রকল্প পাইলট আকারে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করি।

বিশ্ব ব্যাংক আমাদের একটি প্রকল্প দিয়েছে শহর এলাকায় দরিদ্র মানুষের জন্য আবাসন করতে।এটাও এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

একুশে টেলিভিশন: ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে পিকেএসএফের ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আব্দুল করিম: সমাজের যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ। যারা ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, হিজড়া, এতিম। তাদের জন্য পিকেএসএফ বেশকিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আমরা প্রায় সাড়ে ৮০০ ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করেছি। আমরা ভিক্ষুককে তার স্বাক্ষর ও এলাকার প্রতিনিধির সাক্ষরের মাধ্যমে এক লাখ টাকা দিচ্চি। তবে শর্ত দিচ্ছি সে যেন এ টাকা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়, ভিক্ষায় আর না আসে। যদি ভিক্ষায় ফিরে আসে তবে আমাদের এ টাকা আবার ফেরৎ দিতে হবে। এ পর্যন্ত একজন লোক আবার ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে এসেছেন।

একুশে টেলিভিশন: পিকেএসএফের জন্য শুভ কামনা, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।

আব্দুল করিম: আপনাকেও ধন্যবাদ, একুশে টেলিভিশন পরিবারকে ধন্যবাদ।

এসএইচ/ এআর